পঞ্চখণ্ড আই প্রতিবেদক: শুদ্ধি অভিযান আতংকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাউশি, এনসিটিবি ও শিক্ষাবোর্ডে’র সুবিধাভোগীরা। তাদের তালিকা করে বদলি কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। পাশাপাশি প্রকল্পমধুর কর্তাদেরও সরিয়ে দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে তিনজন শিক্ষামন্ত্রী দায়িত্বে ছিলেন। প্রথম দুই টার্মে ১০ বছর ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ, এরপর দীপু মনি এবং সর্বশেষ ছিলেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এই তিন মন্ত্রীর সময় শিক্ষা প্রশাসনে ঘুরেফিরে যারা ছিলেন তাদের তালিকা করে বদলি কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার।
নাহিদের আলোচিত এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ, দীপু মনির ভাই ওয়াদুদ টিপু এবং নওফেলের এপিএসের হাত ধরে পোস্টিং পাওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি হয়েছে। এখন ধাপে ধাপে তাদের বদলি করা হবে।
দীপু মনির বিশ্বস্ত মাউশির ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত প্রশাসন শাখার উপ-পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস। গত রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) তাকে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ, বদলি ও এমপিওভুক্তিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
নওফেলের মাউশি প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক তানভীর হাসান। তাকেও ইতোমধ্যে বদলি করা হয়েছে।
মাউশির আইন শাখায় আল আমিন সরকার আছেন ২০০৮ সাল থেকে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মামলা এবং এমপিও সংক্রান্ত সমস্যা নিষ্পত্তি করে দেওয়ার নামে তার অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি ছিল সবার মুখে মুখে।
মাউশির কলেজ শাখার উপ-পরিচালক কিশোর কুমার মহন্ত নওফেলের কোটায় পোস্টিং পান। তিনি এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর সুপারিশে এখানে আসেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাধ্যমিক শাখার পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলী গত ৫ আগস্টের পর অফিস করছেন না। একই শাখার সহকারী পরিচালক দুর্গা রানী সিকদার একজন স্কুল শিক্ষক হয়েও মাউশিতে আছেন ১৫ বছর। তার স্বামী প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য। মাউশিতে তাদের এ জুটি সবার কাছে আলোচিত। উপ-পরিচালক (বিশেষ শিক্ষা) তারিকুল ইসলামও রয়েছেন বদলি আতঙ্কে। তিনি তদবির বাণিজ্য ও গ্রুপিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
Π এনসিটিবি’র বোর্ডে বদলি শুরু:
শিক্ষা প্রশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপানোর হাজার কোটি টাকার টেন্ডার হয় এখান থেকে। শিক্ষামন্ত্রীসহ প্রশাসনের সবার নজর থাকে এই বোর্ডে। সেই বোর্ডে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা ফরহাদুল ইসলাম ইতোমধ্যে সরে গেছেন। বদলি করা হয়েছে দীপু মনির ক্যাশিয়ার খ্যাত সচিব নাজমা আখতারকে। নাজমার বিরুদ্ধে প্রকাশক ও মুদ্রাকরদের কাছ থেকে পার্সেন্টেজ নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তৎকালীন চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলামকে নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন তিনি।
গত ৯ সেপ্টেম্বর বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক সদস্য সাইদুর রহমান, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম সদস্য মোখলেস-উর-রহমানসহ সিন্ডিকেটের ছয়জনকে বদলি করা হয়েছে। এ বদলির তালিকায় রয়েছেন- কমন সার্ভিস শাখার উপসচিব এনসিটিবির ক্ষমতাধর সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সমিতির কোষাধ্যক্ষ। এছাড়া বদলির জন্য আরও এক ডজন কর্মকর্তার তালিকা করা হয়েছে।
Π তালিকা হচ্ছে ১১টি শিক্ষাবোর্ডেও:
দেশের ১১টি শিক্ষাবোর্ডে চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে শিক্ষা ক্যাডার থেকে ডেপুটেশনে পদায়ন হয়। বিগত সরকারের আমলে পদায়ন হওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১ সেপ্টেম্বর কারিগরি শিক্ষাবোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে নওফেলের বিশ্বস্ত মামুন-উল-হককে। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সমিতির সভাপতি। বাকি বোর্ডগুলোতে চলতি মাসের মধ্যে রদবদল হবে বলে জানা গেছে।
Π প্রকল্পের মধু’তে নজর দিচ্ছে সরকার:
শিক্ষা, মানোন্নয়ন, আইসিটি ও অবকাঠামোসহ একাধিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব প্রকল্পে প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন দেওয়া হয়।
‘কেউ যদি মধু খেতে চায় সে যেন প্রকল্পে যায়’— এমন একটা কথা চালু রয়েছে শিক্ষা ক্যাডারে। এবার সেই মধুতে হাত দিচ্ছে সরকার। যারা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও দীর্ঘদিন ধরে আছেন এমন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ তালিকায় রয়েছেন সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (সেসিপ) পরিচালক সামসুন নাহার। তিনি ২০১৪ সাল থেকে এ প্রকল্পের পরিচালক। আছেন আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প (২য় পর্যায়) পরিচালক নওসের আলী ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক এ এস এম এমদাদুল কবীর। এছাড়া আছেন ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক মীর জাহিদা নাজনী।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ মিডিয়া মাধ্যমকে বলেন, ‘যারা দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় আছেন এবং নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের ধীরে ধীরে বদলি করা হচ্ছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। সামনে আরও বদলি করা হবে।’
এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রফেসর রেজাউল করিম মিডিয়া মাধ্যমকে বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন করে মন্ত্রণালয়। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেয় এবং বদলি করে।’