1. news@panchakhandaeye.com : পঞ্চখণ্ড আই : পঞ্চখণ্ড আই
  2. info@www.panchakhandaeye.com : পঞ্চখণ্ড আই :
বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৩ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ :
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীর বার্ষিক নতুন ফি নির্ধারণ করে দিলো সরকার শিক্ষকদের ‘কল্যাণ ভাতার’ চাপ নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনে! নতুন বেতন কাঠামোসহ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯ দাবি কোরআন সর্বোচ্চ পবিত্র ও মর্যাদাসম্পন্ন একটি গ্রন্থ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হজ প্যাকেজ ঘোষণা, সর্বনিম্ন খরচ ৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা জনগণের সেবায় সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় ‘ফুল টাইম’ প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে : উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি বিয়ানীবাজার শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন ইউনিয়ন পরিষদ বাতিলের বিষয়ে যা বললেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা

পোড়া মাটির কান্না

ঝর্ণা মনি, ভোরের কাগজ, ঢাকা
  • প্রকাশিত: বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৪
  • ৭৯ বার পড়া হয়েছে

ঝর্ণা মনি : মঙ্গলবারের বিকাল। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৫টা বেজে ২১ মিনিট। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের মুখে লোহার নিরাপত্তা বেষ্টনী। এক পাশে বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট গেটের মুখে কয়েক জনের জটলা। কেউ ভেতরে যেতে চাইলে আটকে দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর অফিসের পরিচয়পত্রসহ মোবাইল ফোনে ছবি তুলে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন গেটে দায়িত্ব পালনকারী ছাত্রদের টিম প্রধান। ঝরাপাতা মাড়িয়ে সামনে এগোতেই স্বাগত জানালো পোড়া গন্ধ। মাত্র দশ দিন আগেও যে বাড়িটি ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক, এখন এখানে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। সর্বত্র পোড়া গন্ধ। ভবনের সামনে লেকের পাড়ে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতিটি আর নেই। ওখানে আধা পোড়া দেয়ালটি সাক্ষ্য দিচ্ছে ধ্বংসলীলার। অন্যদিকে, ৩২ নম্বরের দেয়ালে আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিটির চিহ্নমাত্র নেই। লেকপাড়ের পুস্তক বিপণিবিতানটির বদলে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে কিছু শিক্ষার্থী। কেউ কেউ ছাত্র আন্দোলনের গ্রাফিতি আঁকছে। মূল ফটকও আটকানো বাঁশের গেট দিয়ে। সতর্ক পাহারায় দশ/বারোজন শিক্ষার্থী।

কে বলবে এই সেই ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি, বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন বা বঙ্গবন্ধু ভবন? যে ভবনের প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে জড়িত বাঙালির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস। যে ভবন থেকে একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেই ভবনের দগ্ধ হয়ে যাওয়া ইটগুলো কি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে তীব্র দহন? একটু এগিয়ে গেলাম মূল ফটকে। লোহার রেলিংয়ে কাগজে টাঙানো নোটিস, ‘তারুণ্যের পরিচ্ছন্নতা অভিযান কর্মসূচি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।’ ভেতরে যেতে পরিচয় দেয়ার পর পাহারারতদের সাফ জবাব, ‘ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাড়ির ভেতরে কেউ যেতে পারবে না। নট আ সিঙ্গেল পারসন। যা দেখার বাইরে থেকে দেখে যান।’

অনেক অনুনয়-অনুরোধে মন গলল পাহারারতদের। বলল, শুধু লেখবেন কিন্তু কোনো ছবি তুলতে পারবেন না। বললাম, তথাস্ত। ছবি তুলবো না। এই পোড়া মাটির দহনে জ¦লছি, ছবি তুলে হৃদয় খুঁড়ে বেদনার ক্ষত আর গভীর করতে চাই না। পোড়া ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা বাঙালির ইতিহাস দেখতে গাইড হিসেবে সঙ্গে একজন শিক্ষার্থীকে দেয়া হলো। বাঁশের গেট পেরিয়ে এক টুকরো উঠোনে যেতেই রুদ্ধ হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। উৎকট পোড়া গন্ধে জ¦ালা করছিল নাকমুখ। তবুও পোড়া চোখ খুঁজে ফিরছিল সাদা সিমেন্টে তৈরি বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু একি! ভাস্কর্যটি আর নেই। শুধু ছাই ভস্মের স্তূপ।

বঙ্গবন্ধুর মূল বাড়িটি তিন তলা। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় যে অবস্থা ছিল, যত দূর সম্ভব অবিকল সেই অবস্থায় বাড়ি, আসবাব, গুলি চিহ্নিত দেয়ালগুলো, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র সব সংরক্ষণ করে বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। পরে মূল বাড়ির পেছনে একটি নতুন ভবন করে সেখানে পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র ও সেমিনার কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল।

প্রথমেই নিচতলায় গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোবাইল ফোনের আলোই একমাত্র ভরসা। মনে হচ্ছিল, কয়লা হয়ে যাওয়া কোনো সভ্যতায় দাঁড়িয়ে

আছি আমি। আমার সামনে পেছনে অন্ধকার আর ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছু নেই। কিছু ছিল না কোনোকালে। দরজা-কপাটহীন পুড়ে যাওয়া অন্ধকার কক্ষে স্মৃতি হাতড়ে ফিরছিলাম, এইখানে কাঁচের দেয়ালের ভেতর বঙ্গবন্ধুর লেখার টেবিল ছিল, বঙ্গবন্ধুর পোশাক সংরক্ষিত ছিল, ছিল বঙ্গমাতার ব্যবহৃত পানের কৌটাসহ নানা আসবাব। দেয়ালে ছিল পারিবারিক ছবি, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবি। কিন্তু দেয়াল কোথায়? দেয়ালগুলো কালো হয়ে আছে ধোঁয়ায়। অন্ধকারেই সিঁড়ি দিয়ে এগুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। এই তো এই সিঁড়ি, এই সেই সিঁড়ি, যেখান থেকে বুলেটবিদ্ধ বঙ্গবন্ধুর রক্ত গড়িয়ে গিয়ে রক্তাক্ত করেছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। এই সিঁড়ির রক্তই তো মিশে গিয়েছিল পদ্মা-মেঘনায়। এই সিঁড়ি এখন আর কিছুই সাক্ষ্য দেয় না। এই সিঁড়ি এখন শুধুই পুড়ে যাওয়া আগুনের কথা বলে। আর তাই তো আগুনে ছাই করে দিয়েছে সিঁড়িতে লুটিয়ে পরা বাঙালির সিংহপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত সেই ছবিটিও।

দ্বিতীয় তলায় ছিল শেখ হাসিনার শয়নকক্ষ, শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ জামাল, শেখ কামাল ও শেখ রেহানারও ঘর ছিল দ্বিতীয় তলাতেই। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর সংলগ্ন একটি ঘর যেখানে তিনি টেলিভিশন দেখতেন এবং পরিবারের সঙ্গে খাবার খেতেন। এই ইতিহাস আর কেউ খুঁজলেও পাবে না। দরজা-কপাট পুড়ে যাওয়া প্রতিটি ঘরের শুধুই নারকীয় উল্লাসের ধ্বংসযজ্ঞ। তবুও দুটি চোখ খুঁজেছিল ছোট্ট শেখ রাসেলের জিনিসপত্র; যেমন- বল, অ্যাকোয়ারিয়াম, খেলনা এবং ঘড়ি। কোন ছাইয়ের সঙ্গে মিশে আছে শিশু রাসেলের খেলনাগুলো কে জানে! মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামালের স্মৃতিস্মারক, নব পরিণীতা দুই বধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালের বিয়ের শাড়িগুলো কোন ছাইয়ের জঞ্জালে লুকিয়ে আছে ইতিহাস কি মনে রাখবে তার কিছু?

বাড়ির তিনতলা পর্যন্ত প্রতিটি ঘরের দরজা-কপাট পুড়ে গেছে। জিনিসপত্র যা ছিল সেগুলো লুট হয়ে গেছে। চারদিকে উৎকট গন্ধ। পুড়ে গেছে দেয়ালগুলো। ভেতরে ধ্বংসস্তূপ আর ভাঙা কাঁচের টুকরো। দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্রাচীন পরিত্যক্ত কোনো পোড়াবাড়ি কিংবা জনবসতিহীন ভূতুড়ে প্রাঙ্গণ। বাড়ির প্রতিটি কামরা শূন্য থাকলেও পোড়া গন্ধে এখনো ভারি হয়ে আছে বাতাস। মূল বাড়ির পেছনে একটি নতুন ভবন করে সেখানে পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র ও সেমিনার কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। এটিও আজ অতীত। মূল বাড়ির পাশে ছিল রান্নাঘর, দুটো আলাদা ছোট ঘর কবুতরের জন্য। এগুলো শুধু পোড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে।

ইতিহাসের খেরো খাতা জানান দেয়, ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও মহান একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ যুদ্ধের প্রথম উত্তাল দিনগুলোতে এই বাড়িতে বসেই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির আন্দোলনের সূতিকাগার এই বাড়িতেই সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা ও রাজনৈতিক বিভিন্ন মিটিং করতেন বঙ্গবন্ধু। ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এই বাড়ি থেকেই। এই বাড়ি থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার করে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে এখান থেকেই তার রাষ্ট্রীয় কর্মপরিচালনা করতেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে সপরিবারে এই বাড়িতেই প্রাণ দিতে হয় জাতির জনককে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা ১৯৯৩ সালে বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে ট্রাস্ট বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। গত ৫ আগস্ট মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আক্রান্ত হয় ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়, চলে ভাঙচুর-লুট। লুট করে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত আসবাবপত্র। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ নথি-দলিলসহ সবকিছু। ৩২ নম্বর এখন শুধুই আগুনে পোড়া আর লুট হয়ে যাওয়া এক হাহাকারের সভ্যতা। এই অন্ধকার হয়ে যাওয়া সভ্যতা যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, ইতিহাসের অন্ধকারময় বাংলাদেশের ইতিবৃত্ত। এই ইতিবৃত্তে স্তব্দ হয়ে পা ফেলতে গিয়েও শঙ্কিত হচ্ছিলাম বারবার, এখানে এই ছাই-ভস্ম-ধ্বংসস্তূপে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত কিছু মিশে নেই তো? হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল বারবার, কিন্তু পোড়া চোখে তখন আষাঢ়-শ্রাবণ ঢলের বড্ডো অভাব। চৈত্র্যের খরতাপে পুড়ছিল দুই চোখ আমার।

৩২ নম্বরে যাওয়ার সময় জাতির পিতার প্রতি প্রণতি জানাতে একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাগে পুড়ে। ফেরার সময় আবার গেলাম সেই অভিশপ্ত সিঁড়িতে; যেখানে বুলেটবিদ্ধ হয়েছিল ‘আমাদের বাংলাদেশ’। কম্পিত হাতে সিঁড়িতে গোলাপগুলো ছড়িয়ে দিয়ে মনে মনে বললাম, ক্ষমা করো, পিতা।

সৌজন্যে: ভোরের কাগজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট