|| আতাউর রহমান ||
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ‘জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে বিবৃতি আদায়ের’ প্রতিবাদে এবং গুম-গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও ছাত্র-জনতা হত্যার বিচারের দাবিতে গতকাল (২৯ জুলাই) রাজধানী ঢাকা’র কয়েক জায়গাসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, যশোর, বরিশালে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ৯ দফা দাবি মেনে নেওয়া না হলে তারা এক দফার আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাবে-এমন আওয়াজ উচ্চারিত হচ্ছে। এদিকে সরকারিভাবে আজ ৩০ জুলাই কোটা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে সারা দেশে শোক পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে চলমান এমন পরিস্থিতি কেন দেখতে হচ্ছে? যেখানে আন্দোলনকারীদের দাবি আগাম মেনে নিল সরকার। আন্দোলনকারীদের পক্ষে আদালতের নির্দেশনাও একইরকম আসলো। অর্থাৎ কোটা প্রসঙ্গে সরকার, আন্দোলনকারী ও তাদের সমর্থক, এমনকি আদালত একমত হওয়ার এমন বিরল ঘটনা বাংলাদেশে এইবার প্রথম ঘটলো। তারপরও কেন আন্দোলন থামানো যাচ্ছে না? আসলে এবারের আন্দোলনটি কোটা নিয়ে সূত্রপাত হলেও তা আর কোটাতে ছিল না, তা সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ মাত্রই বুঝে গেছে। এক্ষেত্রে রাজনীতির বিষবাক্সের মিথ্যাচার ও গুজবের উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে দিয়েছে। মসনদ লাভের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য যাদের শখ, তারাই পেছন থেকে রসদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এরকম কোন কোন গোস্টির উপস্থিতিকে তো অবহেলা করা যায় না!
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে এরশাদবিরোধী আন্দোলন দেখেছি, নির্বাচন প্রতিহত করণসহ অনেক আন্দোলন দেখেছি। কিন্তু আন্দোলনের মাত্র পাঁচ-ছয় দিনে এতো প্রাণহানি এদেশে কখনো ঘটেনি। আর এভাবে শিক্ষার্থীদের এমন বেপরোয়া মনোভাব প্রদর্শন করতে আগে কখনো দেখিনি। হঠাৎ করে এত উচ্ছশৃংখল হয়ে উঠার পেছনে কে বা কারা দায়ী। এমন প্রসঙ্গে গত ২৮ জুলাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাংক ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলেন, স্যার একটা প্রশ্ন করি? বললাম, করেন। তিনি জাতীয় একটা পত্রিকা দেখিয়ে বললেন, সকল খবর পত্রিকা লিখে, কিন্তু কতজন মারা গেল, এ সংবাদটি কেন আসছে না। আমি উত্তরে তাঁকে বললাম, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় নিহতদের পরিসংখ্যান দিতে-তো তথ্যপ্রমাণ লাগবে, অনুমাননির্ভর তো দেয়া যাবে না। তবে সরকারি সূত্রে ১৪৭ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশেও আছে নানান প্রচারণা। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে রাষ্ট্র একদিন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সেই নিরীখে এ পরিসংখ্যান স্পষ্ট করা আবশ্যক। আসলে কতজন ছাত্র, কতজন নাগরিক, কতজন শিশু-কিশোর, কতজন নারী, কতজন পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে- তা পরিচয় সহকারে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনটি আদৌ কি সরকারের বিরুদ্ধে ছিল? না-কি সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে ছিল? যেখানে কোটা সংস্কার প্রসঙ্গটি বিচারাধীন, সেখানে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কি করার ছিল? সেই কোটা প্রসঙ্গ নিয়ে ছাত্রলীগই যথেষ্ট- এমন ঘোষণা দেয়ার কী এতো দরকার ছিল। আর সংস্কার আন্দোলনকারীরা কেন আদালতের রায়ের অপেক্ষা করতে পারলো না? এ সময় কমপ্লিট শাটডাউন না দিলে কী শিক্ষার্থীদের পরাজয় হয়ে যেত? এ আন্দোলন বেহাত করতে অতি পণ্ডিতি আর চুলকানি ধাচের ল্যাংগুয়েজ কী কম দায়ী! কোন প্রবীণের কিংবা কোন নবীনের ভুলের কারণে সমগ্র জাতি পিছিয়ে পড়ুক কিংবা আগামী প্রজন্ম হতাশায় নিমজ্জিত হোক, সেটা আমরা কেউ চাই না। কোনভাবে অস্বাভাবিক অবস্থায় সিভিল ওয়ার ঘটুক, সেটাও দেশপ্রেমিক কেউ কামনা করে না। আমাদেরকে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থান খুঁজে বের করতেই হবে। দেশে একসঙ্গে এত রক্ত ঝরেনি অতীতে। সরকারি সূত্রমতে, নিহতের সংখ্যা দেড়শ’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, নিহতদের আরও তথ্য অনুসন্ধানের কাজ চলছে। কিন্তু মাটিতে রক্তের দাগ রেখে যারা চিরবিদায় নিয়েছেন, তাদের স্বজনরা যেন শোক সহ্য করার শক্তি লাভ করে, এ প্রার্থনা করি। আর এক্ষেত্রে সহিংসতার অভিযোগ ঢালাওভাবে না নেওয়া মঙ্গলজনক। এতে আইনী প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবার সম্ভাবনা কম থাকবে, গ্রহনযোগ্যতা বাড়বেও। কিন্তু এত উন্নয়নের স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির স্বপ্ন দেখানোর পরও মানুষ কেন ক্ষুব্ধ, সেদিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে ক্ষমতাশীল সরকারকে। ভোটাধিকারের গুরুত্ব আমলে নিয়ে আগামী দিনগুলোর নির্দেশনা পূঁজি করে যেতে হবে বহুদূর। আর সকল পলিটিক্যাল নেতৃত্বের ভাষা আক্রমণাত্মক না হলে ভালো হয়। এজন্য শাসকদলের অগ্রণী ভূমিকা অপরিহার্য।
আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীলদের কাজ কি? তাঁদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন কিভাবে ছিনতাই হয়ে গেল? যারা দেশে এমন ধ্বংসাত্মক ও বিনাশের ঘটনা ঘটলো, তার দায়ভার কে নেবে? এসব খতিয়ে না দেখলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারে রয়ে যাবে। এখানেও ঐতিহাসিক মীরজাফর-মোশতাকদের উপস্থিতি কিংবা কোনরূপ সংশ্লিষ্টতা ছিল কি-না, তাও আমলে নেয়া দরকার। দেশের পরিবেশ বিনষ্টকারী ও নাশকতাকারীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। মূলত: দেশের জানমালের নিরাপত্তা যাদের জন্য হুমকিস্বরূপ, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি।
মূলত ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু। ২০১৮ সালে এসে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা বৈষম্য থেকে মুক্তির দাবিতে সারা দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। গত ৫ জুন মহামান্য হাইকোর্ট সেই কোটা পদ্ধতি বাতিলে জারিকৃত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। পরিপত্র বাতিলের কারণে সারা বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা আবারো রাজপথে দাবি আদায়ের আন্দোলনের ডাক দেয়।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সাম্য এবং মেধার বাস্তবায়ন সকলেই চায়। কিন্তু সরকারি চাকরিতে যে ৫৬% কোটা বিদ্যামান ছিল। এর মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% জেলা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা বিদ্যমান। ২০০৪খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২৪খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গেল ২০ বছরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি-সহ যারা ক্ষমতায় থেকে সরকার পরিচালনা করলেন, তারা কেন কোটা প্রথার মিমাংসা করলেন না। আজ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন এক দফার আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে বিবৃতি দিচ্ছেন? এর রহস্য সকলেরই কম-বেশি জানা!
দেশে কোটা সংস্কার না হওয়ায় প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি পাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন করলেন বিয়ানীবাজার পৌরসহরের ইকরা ফ্যাশনের স্বত্তাধিকারী এক সমাজ সংস্কারক মো: গিয়াস উদ্দিন। তাঁর কথার সাথে একমত না হয়ে বুঝিয়ে দিলাম- এটা একটা ভুল ধারণা। মূলত যারা সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেন, তারা প্রথমত: প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। দ্বিতীয়ত: ১ম ধাপে উত্তীর্ণরা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। লিখিত পরীক্ষায় ২য় ধাপে যারা উত্তীর্ণ হয়, তারাই পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হতে হয়। অর্থাৎ প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা উত্তীর্ণের মধ্য দিয়ে প্রকৃত মেধাবীরাই সরকারি চাকুরীর অন্তর্ভুক্ত হন। তৎপরবর্তীতে উত্তীর্ণ মেধাবীদের মধ্যে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ বন্টন হয়ে থাকে। সুতরাং মেধাবী ছাড়া কোটাভুক্ত হওয়ার সুযোগই নেই। সুতরাং মেধাবীদের নিয়োগ না দিয়ে অযোগ্যরা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নিচ্ছে, এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ দূরভীসন্ধিমূলক প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সরকারি চাকরিতে এই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতির কারণে টানা ১১ দিন বন্ধ ছিল মোবাইল ইন্টারনেট সেবা। এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা স্থগিত। দেশের মানুষের দৃষ্টি কোটা সংস্কার আন্দোলনের দিকে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সরকারকে আরও কঠোর হতেই হবে। এ সহিংসতায় সরকারি সূত্রমতে, এ সহিংসতায় ১৫০ জনের প্রাণহানির তথ্য দেয়া হয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেন, পঙ্গুত্ব বরণ করলেন, যুদ্ধে যাওয়ার কারণে রাজাকার এবং পাকিস্তানি বাহিনী কতৃক তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট হলো।সেই মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্তানাদি, নাতি-নাতনি বীরের বংশধর। তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা একেবারে অনুচিত। আর আবেগের বশবতী হয়ে আমাদের মেধাবী প্রজন্মরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিজেদেরকে ‘রাজাকার’ ঘোষিত করে যেভাবে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে, তা মেধাবীদের বেলায় মানায় না; আদৌ উচিত হয়নি। প্রতিবাদের ভাষা অন্যরকম হতে পারতো। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন রাষ্ট্রে ‘রাজাকার’ শব্দটার পুনর্বাসন কোনক্রমেই সুখকর মনে হয়নি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার প্রসঙ্গে শুধু একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেনও, আমি শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকার বলিনি। অভিভাবকদের ভাষা মেধাবীদের সহজভাবে বুঝা উচিত ছিল। কারণ, তারাই হবে আগামীর ভবিষ্যত।
এ কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সারা দেশে জনমনে যে চরম অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠার জন্ম হয়েছে, তা স্বাভাবিক হতে অনেক দিন যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও গুজব নির্ভর অধিকাংশ অপপ্রচারে জনমনে আরও বেশি আতংক বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি স্থাপনায় জ্বালাও পুড়াও, ভাঙ্গচুর, কারাগারে হামলা, বিটিভি তছনছ করা, মেট্রোরেল, সেতু ভবন ভাংচুর, লুটপাট, ইন্টারনেট জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনার সাথে আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ততা ছিল না। সেই কারণে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হরদম মাঠে কাজ করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য গ্রফতার, সাধারণ ছুটি, কারফিউ, সেনাবাহিনী মোতায়েন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। তা না হলে জনজীবন স্বাভাবিক রাখা অসম্ভব হয়ে উঠতো। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক- এটিই দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক।