
– Π আতাউর রহমান
একসময় ‘লকডাউন’ ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি শব্দ—সংক্রমণ ঠেকানোর উপায়। কোভিড–১৯ মহামারির সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এই শব্দটি মানুষের মনে তৈরি করেছিল এক গভীর আতঙ্ক। রাস্তাঘাট ফাঁকা, যানবাহন থমকে, মানুষের মুখে অজানা ভয়—সব মিলিয়ে ‘লকডাউন’ হয়ে উঠেছিল জীবনের স্থবিরতার প্রতীক।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সেই আতঙ্ক-জাগানো শব্দটিই এখন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে—রাজনীতির অভিধানে! ১৩ নভেম্বরকে ঘিরে ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ‘লকডাউন’ শব্দের ব্যবহার জনমনে যে অনিশ্চয়তা ও ভয় তৈরি করেছে, তা মহামারির দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতিকেই যেন জাগিয়ে তুলছে। এবার কারণ ভাইরাস নয়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
আতঙ্কের পুনর্জন্ম
রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন ও গণসমাবেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন এসব কর্মসূচি সাধারণ নাগরিকের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৩ নভেম্বরের ঘোষিত কর্মসূচিকে ঘিরে অফিসগামী মানুষ, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, শিক্ষার্থী—সবার মাঝেই এখন এক অঘোষিত ভয়ের বাতাস বইছে। মানুষ জানতে চায়, সেদিন কি রাস্তায় বের হওয়া নিরাপদ হবে?
এই ভয়ের মূলে রয়েছে অতীত অভিজ্ঞতা। পূর্ববর্তী হরতাল, অবরোধ কিংবা রাজনৈতিক সংঘাতে জনজীবন যে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা ভোলা যায়নি। জ্বালানো গাড়ি, স্থবির ব্যবসা, আহত মানুষ—এই সবই ‘লকডাউন’ শুনলেই এখন মনে পড়ে যায়। ফলে, রাজনৈতিক আন্দোলন নয়—আতঙ্কই যেন আগেভাগে ছড়িয়ে পড়ে জনগণের মনে।
অর্থনীতি ও আস্থার সংকট
রাজনীতির এমন কর্মসূচি কেবল নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগই সৃষ্টি করে না, বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও ব্যাহত করে। দেশের প্রতিদিনের উৎপাদন ও ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণ কোটি কোটি টাকায়। রাজধানী ঢাকা যদি একদিনের জন্যও স্থবির হয়ে পড়ে, ক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকার বেশি। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, পরিবহনশ্রমিক, এমনকি বেসরকারি কর্মজীবীরাও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
অর্থনীতির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল পরিবেশ চান। যখন তারা দেখেন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সাধারণ মানুষের জীবন থামিয়ে দিতে পারে, তখন দেশের প্রতি তাদের আস্থা কমে যায়। একদিনের বিশৃঙ্খলা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলে অর্থনীতির ওপর, যা থেকে পুনরুদ্ধার সহজ নয়।
দায়িত্বশীল রাজনীতির আহ্বান
রাজনীতি কখনো জনজীবনের প্রতিপক্ষ হতে পারে না। বরং রাজনীতি জনগণের কল্যাণের মাধ্যম—এই মৌল নীতিই আজ পুনরুদ্ধারের দাবি রাখে। যে আন্দোলন মানুষকে আশার পরিবর্তে ভয়ের মধ্যে ফেলে, সেটি গণতন্ত্রের নয়, বরং অনিশ্চয়তার প্রতীক।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে—তাই তো গণতন্ত্র প্রাণবন্ত। কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে হবে দায়িত্বশীল ও মানবিক। সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষেরই উচিত এমন কর্মসূচি ঘোষণা করা যা জনগণের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত না করে বরং তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ বাড়ায়। অন্যথায়, রাজনীতি মানুষের আস্থা হারাবে—আর আস্থা হারানো মানেই গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হওয়া।
শব্দের রাজনীতি ও জনগণের মনস্তত্ত্ব
‘লকডাউন’ এখন কেবল একটি শব্দ নয়—এটি মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। এই শব্দ শুনলেই মনে পড়ে যায় এক নিঃশব্দ শহর, থেমে যাওয়া জীবন আর অনিশ্চয়তার দিনগুলো। সেই মানসিক আঘাত আজও পুরোপুরি কাটেনি। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার অনিচ্ছাকৃতভাবেই মানুষের মনে ভয় জাগায়।
রাজনীতির সাফল্য শব্দে নয়, বার্তায়। যদি সেই বার্তা আশার, স্থিতিশীলতার ও উন্নয়নের হয়, তবে সেটিই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ভাষা ও প্রতীক নির্বাচনে সচেতন থাকা—যেন তা ভয়ের নয়, বরং ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রতিফলন হয়।
ভয়ের নয়, ভরসার রাজনীতি চাই
এখন সময় এসেছে রাজনীতির ধরণ বদলানোর। ক্ষমতা নয়, আস্থা অর্জনই হোক প্রতিযোগিতার মাপকাঠি। জনগণ আজ সংঘাত নয়, স্থিতিশীলতা চায়; ধ্বংস নয়, সমাধান চায়।
১৩ নভেম্বরকে ঘিরে জনমনে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি রাজনীতিবিদদের জন্য একটি বার্তা—মানুষ আর ‘লকডাউন’ দেখতে চায় না, তারা দেখতে চায় কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন। তাই আসুন, রাজনীতি হোক আস্থার প্রতীক, আতঙ্কের নয়।