
পঞ্চখণ্ড আই ডেস্ক :
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেটের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে প্রয়াত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ। দলটি এখনও অনিবন্ধিত হলেও সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জুড়ে তাদের বিপুল অনুসারী এবং সামাজিক প্রভাব স্থানীয় রাজনীতিতে এক অপ্রত্যাশিত আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সুফিবাদভিত্তিক ধারার অনুসারীদের মধ্যে ফুলতলী পরিবারের প্রভাব দীর্ঘদিনের। তাদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আল ইসলাহ সরাসরি রাজনীতিতে অংশ না নিলেও, প্রতিবার নির্বাচনে তাদের অনুসারীদের ভোটের দিকনির্দেশনা নির্বাচনী ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এবারের নির্বাচনেও সেই “সুফি ভোটব্যাংক” নিয়ে জোর আলোচনা চলছে।
সূত্র জানায়, এবারের নির্বাচনে আল ইসলাহের একাধিক নেতা স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হতে পারেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইসলামী সংগঠনের পরিচিত মুখ ও তরুণ প্রজন্মের প্রভাবশালী নেতা।
সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছেন সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ–কানাইঘাট) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ-মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনেও তিনি লড়তে পারেন—এমন ইঙ্গিত মিলেছে দলীয় ঘনিষ্ঠ সূত্রে।
তবে তাঁর অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আওয়ামী লীগের শেষ আমলের নির্বাচনে বিজয়ী(স্বতন্ত্র) হওয়ায় তিনি একাংশের সমালোচনার মুখে পড়লেও, ৫ আগস্টের আগে সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল প্রকাশ্য ও দৃঢ়। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া তখন গণআন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল।
রাজনৈতিক সূত্রমতে, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে বর্তমানে আলোচনায় রয়েছেন মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরীর নাম। যদি বিএনপি শেষ পর্যন্ত তাঁকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দেয়, তাহলে সিলেট অঞ্চলের উলামা ভোটব্যাংকে বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই আসনে বিএনপি-জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুকও প্রার্থী হচ্ছেন। ফলে সমঝোতা হলে এটি হবে সিলেটের সবচেয়ে আলোচিত আসনগুলোর একটি।
আল ইসলাহ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন আসনে একাধিক নেতা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া): সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মাওলানা ফজলুল হক খান, মৌলভীবাজার-৩ (সদর–রাজনগর): সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ আলাউর রহমান টিপু, হবিগঞ্জ-১ (বাহুবল–নবীগঞ্জ): সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর আল ইসলাহর সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসাইন সালেহী, সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক–দোয়ারাবাজার): কেন্দ্রীয় নেতা উপাধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী, মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা–জুড়ী): বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার সাবেক সভাপতি মুফতি বেলাল আহমদ ও সিলেট-২ (বিশ্বনাথ–ওসমানীনগর): যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাবেক ছাত্রনেতা চৌধুরী আলী আনহার শাহান।
এ বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা আবু সালেহ কুতবুল আলম বলেন,
“মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী প্রার্থী হবেন—এমন কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জন-আকাঙ্ক্ষা প্রবল। অনেক আসনে প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। শিগগিরই বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক আসন সমঝোতা হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব কাদের সমর্থন দেব। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের নেতৃত্ব আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিলেট বিভাগের রাজনীতিতে ধর্মীয় ও সুফি ঘরানার ভোটারদের প্রভাব সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এবারের নির্বাচনে আল ইসলাহ ও ফুলতলী পরিবারের সাংগঠনিক প্রভাব “সাইলেন্ট ফ্যাক্টর” হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
আল ইসলাহ আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত না হলেও তাদের অনুসারীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দলে ভোট দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এবার যদি ফুলতলী ঘরানা ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে একাধিক আসনে জয়ের ব্যবধান নির্ধারণে তারা “কিং মেকার” হিসেবে উঠে আসতে পারেন।
শেষ কথা, নির্বাচনের আগে সিলেটের রাজনৈতিক মাঠে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে ফুলতলী ঘরানার অবস্থান। আনুষ্ঠানিক দলীয় নিবন্ধন না থাকলেও “আল ইসলাহ” এখন নির্বাচনী অঙ্কে এক অনিবার্য নাম—যারা নীরবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে, পরিবর্তন আনতে পারে সিলেটের ভোটের সমীকরণে।