
Π আতাউর রহমান:
মানবসমাজের এক অদ্ভুত বৈপরীত্য হলো—যেখানে দায়িত্বহীনতা, স্বার্থপরতা কিংবা ফাঁকিবাজির প্রবণতা দেখা যায়, সেখানে একধরনের অদৃশ্য ঐক্য খুব দ্রুত গড়ে ওঠে। কিন্তু যে মানুষটি নীরবে পরিশ্রম করে, দায়িত্বকে নিজের সম্মানের জায়গায় দেখে, সে অধিকাংশ সময় পথ চলে একাই। সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে এই দৃশ্যপট চোখে পড়ে—অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, এমনকি পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও একই বাস্তবতার উপস্থিতি প্রায় সর্বত্র।
দায়িত্বহীনতার অদ্ভুত সৌহার্দ্য
ফাঁকিবাজদের মধ্যে কেন যেন এক ধরনের স্বার্থজোট তৈরি হয়। তারা একে অন্যকে আড়াল করে, ভুলকে গ্রহণযোগ্য দেখাতে চেষ্টা করে এবং সমালোচনার মুখে পারস্পরিক ঢাল সরবরাহ করে। উদাহরণ সহজেই মেলে—অফিসে এমন অনেক দল থাকে যারা কাজের চেয়ে আড্ডাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যখনই কোনো কাজে ব্যর্থতা আসে, তখন দেখা যায় দায়িত্বজ্ঞানহীনদের “সংহতি” বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
কাজ না করা বা অদক্ষতাকে তারা নিজেদের সাধারণ পরিচয় মনে করে, তাই অজুহাত তৈরিতে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়।
পরিশ্রমীর নিঃসঙ্গতা
অন্যদিকে পরিশ্রমী মানুষটির বাস্তবতা ভিন্ন। সে দায়িত্ব নেয়, পরিশ্রম করে, ফলাফল তৈরি করে; কিন্তু এই একাগ্রতার জন্য তাকে প্রায়ই একা লড়াই করতে হয়। কারণ তার সাফল্য অনেকের চোখে অস্বস্তির কারণ হয়ে যায়। কর্মঠ মানুষ কাজের মান বাড়িয়ে দেয়, প্রতিষ্ঠানে নতুন প্রত্যাশা তৈরি করে—যা অনীহাপূর্ণ দলগুলোর জন্য চাপ হয়ে দাঁড়ায়।
ফলে শুরু হয় তাকে উপেক্ষা করার নীরব প্রচেষ্টা। অনেকে এমন পরিশ্রমী মানুষের সাফল্যকে হুমকি মনে করেন, আবার কেউ কেউ মনে ভিতরে ভিতরে ক্ষুদ্রতা লালন করে। কর্মঠ মানুষ তাই নিঃসঙ্গতা সঙ্গী করে এগিয়ে যায়—কারণ তার যাত্রা নিজের সামর্থ্য ও সততার ওপর দাঁড়ানো।
সমাজের নীরব ক্ষয়
ফাঁকিবাজদের দলবদ্ধতা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না; এটি প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের মূল কারণগুলোর একটি। যে প্রতিষ্ঠানে পরিশ্রমীর চেয়ে ফাঁকিবাজদের প্রভাব বেশি, সেখানে সময়মতো কাজ হয় না, সিদ্ধান্তগুলো ভেঙে পড়ে, দক্ষতা হারিয়ে যায়।
দেখা যায়—যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে কর্মকে ভালোবাসে, তাকে অনেক সময় প্রশাসনিক জটিলতা, হিংসা বা ‘গ্রুপিং’-এর দেয়ালে আটকে থাকতে হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ব্যাহত হয়, আর অদক্ষতার সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে পরিণত হয়।
পরিশ্রমীর শক্তি কোথায়?
যদিও কর্মঠ মানুষকে একা লড়তে হয়, তবুও তার শক্তি অসাধারণ—
● তিনি ফল উৎপাদন করেন, যা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সম্পদ।
● তিনি নিয়ম তৈরি করেন, যেখানে অন্যরা কেবল আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে।
● তিনি মান নির্ধারণ করেন, যা অন্যদের জন্য পথ দেখায়।
● তিনি ঝুঁকি নেন, যা উন্নতির ভিত্তি।
অন্যদিকে ফাঁকিবাজদের দলবদ্ধতা সাময়িক সুবিধা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে তা অকার্যকর। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠান বা সমাজ কখনোই টিকে থাকে না দায়িত্বহীন মানুষের ওপর।
আমাদের করণীয়
একটি সমাজ বা প্রতিষ্ঠান যদি সত্যিকার অর্থেই উন্নতি করতে চায়, তবে তাকে পরিশ্রমীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
● কাজের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা,
● অদক্ষতা ও ফাঁকিবাজির প্রতি শূন্য সহনশীলতা,
● দায়িত্বশীলদের নেতৃত্বে সুযোগ সৃষ্টি,
● যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন—
এসবই ন্যায়ভিত্তিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে।
কারণ উন্নতি কখনো ভিড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আসে না; আসে নিষ্ঠাবান, নীরবভাবে পরিশ্রম করা মানুষদের মাধ্যমে—যারা হয়তো সংখ্যায় কম, কিন্তু সমাজকে এগিয়ে দেয়ার শক্তি তাদের হাতেই থাকে।
শেষ কথা
“ফাঁকিবাজরা দলবদ্ধ থাকে, পরিশ্রমীরা একা লড়ে”—এই কথার গভীরতা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত।
তবুও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—উন্নয়ন, অগ্রগতি ও পরিবর্তন এসেছে সবসময় সেই একাকী লড়াই করা মানুষদের হাত ধরেই।
এই মানুষগুলো হয়তো দলবদ্ধ নয়, কিন্তু তাদের পরিশ্রম ও সততার আলোই শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে।