
পঞ্চখণ্ড আই ডেস্ক :
অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, “আমরা দেখেছি— যারা একসময় সংস্কারের কথা সবচেয়ে বেশি বলত, তারাই এখন সংস্কারবিরোধী রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। তাদের এই অবস্থান দেশের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি নিজেদের জন্যও এটি কোনো সুফল বয়ে আনবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।” শুক্রবার (৭ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা তিনটি বড় প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছি— সংস্কার, বিচার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর। বিচারের অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান; এমনকি আগামী ১৩ নভেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ও ঘোষণা হওয়ার কথা। এর প্রতিক্রিয়ায় ফ্যাসিবাদী শক্তি আবার ঢাকায় লকডাউন ডাকছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নামে আমরা কি আবার একই জায়গায় ফিরে যাচ্ছি না?
গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি উল্লেখ করে আসিফ মাহমুদ বলেন, “সংসদে ৩০০ জন প্রতিনিধির মধ্যে প্রশ্ন হলো— কয়জনের কাছে ২০ কোটি টাকা আছে? আজকের বাংলাদেশে ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা না থাকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণই করা সম্ভব নয়। রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ অর্থনির্ভর কাঠামোয় বন্দি হয়ে পড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যাদের কাছে বিপুল কালো টাকা আছে, তারাই এখন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। আর কেউ যদি অন্যের টাকা নিয়ে নির্বাচন করে, তবে নির্বাচিত হওয়ার পর সেই টাকার মালিকের স্বার্থ রক্ষা করতেই হয়। ফলে গণতন্ত্রের জায়গায় এখন টাকা ও স্বার্থের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা আক্ষেপ করে বলেন, “এই বাস্তবতায় সত্যিকারের নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের বিকাশ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। রাজনীতি এখন আদর্শ নয়, বরং বিনিয়োগের প্রতিযোগিতা।”
আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, “৫ আগস্টের পরে যারা বিপ্লবের স্টেকহোল্ডার ছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সংস্কারবিরোধী রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। এতে করে মুজিববাদী রাজনীতি আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে— যা দেশের জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।” তিনি যোগ করেন, “অনেকে রিয়েকশনালি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছেন। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি নতুন কোনো দিগন্ত খুলছে না; বরং পুরনো প্রভাবশালী ধারাকেই পুনরুজ্জীবিত করছে। এতে রাষ্ট্র ও সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ব্যাহত হচ্ছে।”
বর্তমান রাজনীতিতে বহুল উচ্চারিত শব্দ ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, “আমরা এখনো জানি না, এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে। কেবল কিছু জনপ্রিয় কর্মসূচি বা পপুলার অ্যাক্টিভিজম দিয়ে নতুন কাঠামো তৈরি হয় না।” তিনি আরও বলেন, “যারা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছেন, তারা কি কোনো রূপরেখা দিতে পেরেছেন? কেউ যদি একটি লিফলেট বা প্রস্তাবই না দেয়, তাহলে মানুষ কীভাবে নতুন রাজনীতির দিকে যাবে? পপুলিস্ট একটিভিজম দিয়ে রাষ্ট্রের নতুন কাঠামো গড়া সম্ভব নয়।”
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সভাপতি রিফাত রশীদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজাহার, কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম প্রমুখ।
আসিফ মাহমুদের বক্তব্যে উঠে আসে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির এক গভীর দোলাচল— সংস্কারের আদর্শিক ভাষা ও অর্থনির্ভর বাস্তব রাজনীতির সংঘাত। একদিকে ন্যায্যতা, সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দাবি; অন্যদিকে কালো টাকার প্রভাব, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও বিভ্রান্ত নেতৃত্ব। তার বক্তব্য মূলত এক সতর্কবার্তা— সংস্কারের রাজনীতি যদি অর্থ ও স্বার্থের খেলায় পরিণত হয়, তবে গণতন্ত্র কেবল বাক্যেই থাকবে, বাস্তবে নয়।