পঞ্চখণ্ড আই প্রতিবেদক :
বাংলা ভাষায় প্রযুক্তির পরিসরে সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা যোগ করতে যে কজন ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়েছেন, প্রকৌশলী মো. আজিজুর রহমান তাঁদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম। শুধু অবকাঠামো নির্মাণেই নয়, ভাষাগত ব্যঞ্জনায়ও তিনি রেখে গেছেন স্থায়ী ছাপ। তাঁর চিন্তা, মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য প্রতিফলন ঘটে একটি নামকরণের মধ্য দিয়ে—”সড়ক ও জনপথ”।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন সরকারি বিভিন্ন বিভাগকে বাঙালিত্বের ছোঁয়ায় রূপায়িত করার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন “Communication and Buildings” (C&B) এর উত্তরসূরি নতুন সড়ক বিভাগকে একটি অর্থবোধক ও সহজবোধ্য বাংলা নাম দেওয়ার প্রস্তাব উঠে। প্রকৌশলী মো. আজিজুর রহমান তখন তাঁর প্রজ্ঞা ও ভাষাচেতনার প্রয়োগ ঘটিয়ে নামটি প্রস্তাব করেন—”সড়ক ও জনপথ”। এই নাম শুধু দাপ্তরিক নয়, এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। এ যেন পথের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে ভাষায় বুনে দেওয়া এক সৃজনশীল প্রকাশ।
এই নিবন্ধে আমরা স্মরণ করব সেই মানুষটিকে—যিনি শুধু সড়ক নির্মাণ করেননি, নামের মাধ্যমে গড়েছেন একটি ভাষাগত ঐতিহ্য। “সড়ক ও জনপথ” নামের প্রবর্তক হিসেবে প্রকৌশলী মো. আজিজুর রহমানের অবদান নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষা ও প্রযুক্তি-অঙ্গনের এক গর্বিত অধ্যায়।
● জন্ম ও শৈশব :
মো. আজিজুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বড়দেশ গ্রামে। পিতা মির আরজাদ আলী ও মাতা মাস্তুরা বিবির ঘরে জন্ম নেওয়ার পর অল্প সময়েই তিনি পিতৃহীন হন। শৈশব ও শিক্ষাজীবনের দায়িত্ব নেন চাচা ইদ্রিস আলী। তাঁর মেধা ও অধ্যবসায় তাঁকে দ্রুতই শিক্ষাক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
● শিক্ষাজীবনের চমকপ্রদ অধ্যায়:
১৯৪০ সালে বিয়ানীবাজার পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪২ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪৪ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করে ১৯৪৮ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন।
● কর্মজীবন : উন্নয়নের অগ্রনায়ক
সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে সিঅ্যান্ডবি বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে R&H বিভাগে যোগ দিয়ে বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে ব্যাপক অবদান রাখেন।
তিনি ‘রেস্টিং কর্নার’ নামে হাইওয়ের পাশে যাত্রী বিশ্রাম ও স্যানিটেশন সুবিধা চালু করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৬৩ সালে ‘হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ফিরে এসে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকেন।
● সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতি অনুরাগ:
প্রকৌশল জীবন যাপন করেও তিনি ছিলেন এক সাহিত্যিক হৃদয়ের মানুষ। গান, কবিতা ও ছোটগল্প ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। রাজশাহী বেতারে তাঁর লেখা গান প্রচারিত হয়েছে।
তাঁর প্রকাশিত সাহিত্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রতিক্রিয়া, ছোটোগল্পের সমারোহ, দেশিফুল, ঝরনা খুঁজে নদী ও কালো ফিতা।
● স্বাধীনতা-পরবর্তী অবদান:
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সড়ক বিভাগের জন্য ‘সড়ক ও জনপথ’ নামকরণে তাঁর প্রস্তাবই গৃহীত হয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় ‘লেন কনসেপ্ট’, মার্কিং ও ‘Cats Eye’ ব্যবহার—এসবের সূচনা তাঁর হাতেই।
● অকালপ্রয়াণ:
১৯৭৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সড়ক ও জনপথ বিভাগ) পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ছিলেন ছয় কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।
● উপসংহার :
প্রকৌশলী মো. আজিজুর রহমান শুধুমাত্র এক সফল কর্মকর্তা ছিলেন না, তিনি ছিলেন উন্নয়ন ও সংস্কৃতির যুগলবন্দি। তাঁর কর্ম, চিন্তা ও সাহিত্যচর্চা আমাদের জন্য এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।