‘আসামি অজ্ঞাত’ ও ‘গায়েবি’— শব্দ দু’টিতেই মিশে আছে অদৃশ্য ভয় আর শঙ্কা। সাম্প্রতিক ৫ আগস্টের ঘটনায় বিয়ানীবাজার থানায় দায়ের হওয়া এমন ৩টি মামলায় উপজেলা জুড়ে আতঙ্কে ভুগছেন তিন শতাধিক মানুষ। এসব মামলায় কয়েকজন অভিযুক্তের নাম উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশের নাম ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ খাতার তালিকায়। ফলে অপরাধে সম্পৃক্ততা না থাকলেও গ্রেফতার এড়ানোর ভয়ে এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে আতঙ্ক।
মূলত গায়বি ও অজ্ঞাত পরিচয় মামলা হয়রানিমূলক৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন অথবা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষকে দমনে এই ধরণের মামলা হয়৷ আর অজ্ঞাত পরিচয় আসামির মামলায় হয়রানি ও পুলিশের উৎকোচ আদায়ের বড় সুযোগ থাকে৷
মূলত কোটাপ্রথা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন করেই সামনে এসেছে ‘অজ্ঞাত আসামি’ প্রসঙ্গ। আন্দোলনকারীদের দমাতে কিংবা আন্দোলনে হতাহত-ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের হয়েছে একাধিক মামলা। সেসব মামলার এজাহারে গুটিকয়েক নাম উল্লেখ করে এজাহারে কয়েক হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। অন্তবর্তীকালিন সরকার দায়িত্ব নিয়েই সংস্কার আন্দোলনের মামলা খারিজ করে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিয়েছে।
এদিকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর অতীতের সেই প্রচলিত ট্রেন্ড থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতার ঘটনা পরবর্তী বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ থানায় মোট ৫টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে ১২ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে। এ পাঁচটি মামলায় সাবেক এমপি নুরুল ইসলাম নাহিদকে প্রধান আসামি করা হয় । একইসাথে উল্লেখযোগ্য আসামির নামের শেষে দুই উপজেলার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয়েছে।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ভবনে গত ৫ আগস্ট অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনজন। আহত হন অন্তত ৬০ জন। এ ঘটনায় ২০ আগস্ট থানায় একটি মামলা হয়। এতে প্রবাসী, ৬ জন সাংবাদিক, আওয়ামী লীগের ৭৫ নেতাকর্মী ও অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার বাদী নিহত তারেকের মা ইনারুন নেছা সংবাদ মাধ্যমকে বললেন, সাহায্য দেওয়ার নাম করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে মামলা করা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের জন্য এ বাদী আদালতে আবেদনও করেছেন।
গোলাপগঞ্জে পুলিশ বিজিবি ও সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের নিশ্চিন্ত গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৪) এর স্ত্রী খাদিজা মাহিরুল (মামলা নং-১০-২৫-০৮-২০২৪ইংরেজি ) বাদী হয়ে একটা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় মোট ১১৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ১০০/১১০ জনকে আসামী করা হয়।
অপর একটি মামলা করেন (নং-১১, ২৬-০৮-২০২৪ইং) ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের দত্তরাইল গ্রামের নিহত মিনহাজ (২৩) এর বড় ভাই সাঈদ আলম। এই মামলায় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক মেয়র-সহ মোট ৫৫জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ১০০/১৫০ জনকে আসামী করা হয়।
এর আগে পুলিশ-বিজিবির গুলিতে নিহত গোলাপগঞ্জের ঘোষগাঁও গ্রামের মৃত মোবারক আলীর পুত্র গৌছ উদ্দিন হত্যার ঘটনায় তার ভাতিজা রেজাউল করিম ২৩ আগস্ট (শুক্রবার) গোলাপগঞ্জ মডেল থানায় আরেকটি হত্যা মামলা ( নং-০৮/১৩৬, ২৩-০৮-২০২৪ইং) দায়ের করেন।
অপরদিকে বিয়ানীবাজার থানায় গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সংঘটিত সংঘর্ষে নিহত ময়নুল ইসলামের স্ত্রী শিরিন বেগম বাদী হয়ে ১টি (নং ০৮; ২৬/০৮/২০২৪ইং) এবং অপর নিহত রায়হান উদ্দিনের ভাই বোরহান উদ্দিন বাদী দেখিয়ে পৃথক হত্যা মামলা (নং ০৮; ২৬/০৮/২০২৪ইং) দায়ের হয়।
এদিকে গত আগস্ট মাসে বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী-এমপি ও দলের নেতাকর্মীর নামে এ পর্যন্ত ২৬৮ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করা হয়েছে ২৬ হাজার ২৬৪ জনের। একইসঙ্গে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে।
স্থানীয় সহিংসতায় ‘আসামি অজ্ঞাত’ শব্দের আতংকে গ্রেফতারের ভয়ে যারা আছেন, তাদের কয়েকজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এ প্রতিবেদককে জানালেন, বিগত সরকার পতনের পরে এসব মামলা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দায়ের করা হয়েছে। এ সব মামলায় হাতেগোনা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেও হাজার হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এতে ধরপাকড়ের নামে হয়রানি ও পুলিশের উৎকোচ আদায়ের বড় সুযোগ বাড়বে। কারণ তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহজনক হিসেবে ওই মামলায় যে কাউকে আটক করতে পারে পুলিশ৷ এই ধরণের মামলা রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার হতে পারে৷ কোনো রাজনৈতিক কর্মী বা নেতাকে আটকের পর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও ওই ধরণের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর সুযোগ থাকে৷ এমন আশংকায় রয়েছেন অনেকে। অভিযোগ উঠেছে, কেউ কেউ প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টিও এসব গায়েবি মামলার আশ্রয়ে ফায়দা নিতে তৎপর। ফলে এলাকাজুড়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় পড়ে পরিবার ছেড়ে অনেককে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
একইধারার গায়েবি মামলা আওয়ামী সরকারের গেল ১৬ বছরে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও হয়েছে। সেসব মামলায় আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়েছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে ভূক্তভোগী অনেকের সাথে আলাপ হয়। জানা যায়, কোন ঘটনা না ঘটেলেও তখনকার সময় আইনশৃংখলা বাহিনী বিএনপি-জামায়াতের নামে গায়বি মামলা দিতো। সেসব মামলায় অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার আতংকে কত রাত বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়েছে, তার হিসাব করে বলা কঠিন। গায়েবী মামলার কারণে প্রাণ বাঁচাতে বিয়ানীবাজার উপজেলা বিএনপি নেতা ইউপি চেয়ারম্যান এম এ অদুদ রোকন ও উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি মোর্শেদ আলম বাবর দেশ ছাড়া। মামলার হয়রানির শিকার হন বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুস সবুর, গ্রেফতার হন পৌর ছাত্রদলের নেতা ফয়েজ আহমদ। নির্যাতনের ভয়ে দেশছাড়া হন উপজেলা শিবির নেতা জাকারিয়া আহমদ। উপজেলা জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমীর আবুল খায়ের(চেয়ারম্যান) নারায়নগঞ্জের গায়েবী এক মামলায় গ্রেফতার হন।
এসব গায়েবি মামলা প্রসঙ্গে বিয়ানীবাজার উপজেলা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট আহমদ রেজা বলেন, গত সরকারের আমলে বিএনপি তথা বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের জন্য আমরা আদালতে তালিকা জমা দিয়েছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক দায়েরকৃত মামলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর ও সিলেট-৬ নির্বাচনী আসনে সম্ভাব্য সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, “এ জাতীয় মামলা দু:খজনক। এই এলাকার মানুষেরা বিয়ানীবাজারের মানুষেরা অত্যন্ত ভদ্র ও সম্মানিত। বিদেশের ভায়েরা, বোনেরা তারা রেমিট্যান্স পাঠায় এখানে। এ ভদ্র এলাকার মানুষেরা উদ্বেগের মধ্যে থাকবে সেটা আমার কষ্ট লাগতেছে। আমরা বারবার বলতেছি, অহেতুক হয়রানি যেন না হয়। সন্দেহের ভিত্তিতে আসামি বানানো, সন্দেহের ভিত্তিতে কষ্ট দেই, তা খুবই দু:খজনক। আমার জায়গা থেকে আমার নেতৃবৃন্দকে বলবো খুঁজ নিতে, যেগুলো সঠিক নয়, এ বিষয়ে কি করা যায়- এটা নিয়ে কাজ করবো। আমরা এটার বিপক্ষে। সুনির্দিষ্ট অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত হবে, আইনের মাধ্যমে প্রয়োগ হবে। কিন্তু সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রাজমূলক, ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে আসামি করার বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে খুবই উদ্বিগ্ন ও হতাশ। জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এসব ঘটবে না। ঘটলে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এটার বিহীত ব্যবস্থা করবো- ইনশা আল্লাহ।”
মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না’র মতে এসব মামলা করা হচ্ছে মূলত ‘হয়রানি’র উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এসব মামলা প্রথম ধাপেই টিকবে না। এসব মামলা মানেই একপ্রকার ‘হয়রানি‘ করা। দেশে একটি ট্রেন্ড চালু হয়েছে, কোন বাসাও যদি চুরি হয়, সেখানেও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৮/১০ জনকে আসামি দেখানো হয়। সেই অজ্ঞাতনামাদের ভেতর আমাদের যে কাউকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে ধরে আনে মূলত ইনকামের আশায়। এটাকে বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নজরে আনার চেষ্টা করবো।