আতাউর রহমান:
আজ ১৪ অক্টোবর ব্যক্তিগত একটা কাজে গিয়েছিলাম বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে। পরিপাটি কক্ষে এক আন্তরিক হাসি ও সৌম্য উপস্থিতি দিয়ে স্বাগত জানালেন প্রফেসর সাব্বীর আহমদ। কিছু সময়ের আলাপচারিতায় ভেসে উঠল তাঁর চিন্তার গভীরতা—লেখালেখির অভিজ্ঞতা, শিক্ষকতার আদর্শ, সংস্কৃতি ও শিক্ষার মানবিক দিক নিয়ে এক প্রাণবন্ত কথোপকথন। শব্দের ভেতর যেন প্রকাশ পেল এক আলোকিত মনের প্রতিচ্ছবি, যার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষা, শিষ্টাচার ও সমাজগঠনের অঙ্গীকার। সেই সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ও কথার অনুরণন থেকেই এই লেখার সূচনা। কথোপকথনের শেষে অন্বেষা নামক’বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ বার্ষিকী -২০২৫’ আমার হাতে তুলে দেন।
১৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের গৌরবমণ্ডিত সদস্য অধ্যাপক সাব্বীর আহমদ তাঁর কর্মজীবনের সূচনা করেন ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট পিরোজপুর সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে। এরপর ধারাবাহিকভাবে কক্সবাজার সরকারি কলেজ, জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ, সিলেট মুরারিচাদ কলেজ, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ ও সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সরকারি কলেজে এবং পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ শিক্ষাদীক্ষা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে সদ্য জাতীয়করণকৃত কানাইঘাট সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে তিনি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে ২০২৫ সালের ৬ মে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দুই সন্তানের জনক অধ্যাপক সাব্বীর আহমদ একজন গবেষণামনস্ক শিক্ষক। ইতিহাস বিষয়ের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদিত তাঁর দুটি পাঠ্যপুস্তক কাজল ব্রাদার্স প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত—যা দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীর পাঠভান্ডারে মূল্যবান সংযোজন হিসেবে স্থান পেয়েছে।
কানাইঘাট উপজেলার দক্ষিণ বাণিগ্রাম ইউনিয়নের ছত্রপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই শিক্ষাবিদ একটি সম্মানিত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর দাদা মাওলানা আবু জাফর ইয়াকুব (রহ.) ছিলেন গাছবাড়ি জামিউল উলুম কামিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, আর চাচা জাফর ইউসুফ ছিলেন সত্তরের দশকে সিলেট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ।
অধ্যাপক সাব্বীর আহমদ ১৬শ বিসিএস ফোরামের সিলেট অঞ্চলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির একজন সক্রিয় কর্মী। এর আগে তিনি ২০১৪-১৫ মেয়াদে শিক্ষক সমিতি, সিলেট অঞ্চলের সাংগঠনিক সচিব ছিলেন।
বর্তমানে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর লক্ষ্য—একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তাঁর প্রত্যাশা—
“বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ হবে এমন একটি শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ নয়, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও মানবিক চেতনায় গড়ে উঠবে।”
অধ্যক্ষের প্রত্যাশা ও পরিকল্পনা
১. একাডেমিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি:
নিয়মিত ক্লাসরুটিন, শিক্ষার্থী উপস্থিতি ও ফলাফল মূল্যায়নের মাধ্যমে কলেজের একাডেমিক মান আরও উন্নত করা।
২. ডিজিটাল প্রশাসন বাস্তবায়ন:
ভর্তি, উপস্থিতি, ফলাফল ও অফিস ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল সিস্টেম চালু করে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি।
৩. গবেষণা ও সৃজনশীল চর্চার পরিবেশ তৈরি:
শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদান, কলেজ ম্যাগাজিন ও জার্নাল প্রকাশে উদ্যোগ।
৪. নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চা:
শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম ও মানবিকতা জাগ্রত করতে নিয়মিত আলোচনা ও সেমিনার আয়োজন।
৫. ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়ন:
নতুন ভবন, আধুনিক ল্যাব, স্মার্ট ক্লাসরুম ও সবুজ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা—যাতে শিক্ষার্থীরা পান মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ।
৬. সহশিক্ষা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ:
সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিতর্কচর্চাকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বগুণ বিকাশে সহায়তা।
৭. শিক্ষক–শিক্ষার্থী সম্পর্কের সেতুবন্ধন:
পরামর্শমূলক সভা ও উন্মুক্ত সংলাপের মাধ্যমে শিক্ষক–শিক্ষার্থী সম্পর্ককে আরও মজবুত করা।
৮. কমিউনিটি সংযোগ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা:
স্থানীয় সমাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে শিক্ষা–সংস্কৃতি ও মানবিক সেবায় কলেজকে নেতৃত্বদায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
অধ্যাপক সাব্বীর আহমদ বিশ্বাস করেন—“শিক্ষার লক্ষ্য কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নয়, বরং মানুষকে চিনতে শেখা, মানবতাকে ভালোবাসতে শেখা।”
এই দর্শনেই তিনি বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজকে রূপ দিতে চান এক জ্ঞাননন্দন, নৈতিক ও আধুনিক শিক্ষার মডেল ক্যাম্পাসে।