✍️ আতাউর রহমান :
□ পঞ্চখণ্ডের প্রজ্ঞাধর্মী ইতিহাস :
বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত সিলেট—যার বুকে বয়ে চলেছে সুরমা, কুশিয়ারা ও সুনাই নদী। এই নদীবিধৌত জনপদেই গড়ে উঠেছে পঞ্চখণ্ড, অর্থাৎ বর্তমান বিয়ানীবাজার উপজেলা—এক গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক অঞ্চল। ইতিহাসের পাতায় এ জনপদকে ‘ক্ষুদে নবদ্বীপ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে—এক সময়ের জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির প্রতীক সেই নবদ্বীপের নামানুসারে। এখানকার শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতির জ্যোতিষ্করূপেই এই অভিজ্ঞান।
□ পত্র-পত্রিকা ও আধুনিক সাহিত্যচর্চা : পঞ্চখণ্ডের অগ্রণী ভূমিকা
সিলেট অঞ্চলে আধুনিক সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার সূচনাও হয়েছিল এই পঞ্চখণ্ডের সন্তানদের হাত ধরে। ১৮৭৪ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’ এর সম্পাদক ছিলেন শাহবাজপুর নিবাসী কবি ও সাংবাদিক প্যারিচরণ দাস। তার জন্মস্থান বর্তমান বিয়ানীবাজারের জলঢুপ থানা এলাকায়।
□ নারী সাহিত্যচর্চার পথিকৃৎ : কৃষ্ণপ্রিয়া চৌধুরাণী
সিলেটের ইতিহাসে প্রথম নারী কবি হিসেবে খ্যাত কৃষ্ণপ্রিয়া চৌধুরাণী ছিলেন জলঢুপ গ্রামের কৃতিসন্তান। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘নারীমঙ্গল’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালে। তাঁর রচিত আরেকটি গ্রন্থ ‘সংহার পরিহার’ (১৯৩০) গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে নারীর চেতনা ও বেদনার কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। নারীশিক্ষা প্রসারেও তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
□ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যপ্রতিভা ও গ্রন্থসমূহ :
প্রাক-ব্রিটিশ যুগ থেকে পাকিস্তান আমলের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত বিয়ানীবাজারে যাঁরা সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট নাম ও তাঁদের রচনার তালিকা নিচে উপস্থাপন করা হলো:
১. পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি : জন্ম খাসা পণ্ডিতপাড়া। গ্রন্থ: চিন্তামণি দীধিতি, প্রামাণ্যবাদ, পদার্থ রত্নমালা, ক্ষণভঙ্গুরবাদ ইত্যাদি।
২. মহেশ্বর ন্যায়লঙ্কার : জন্ম- সুপাতলা। গ্রন্থ: অষ্টবিংশতি প্রদীপ, ভাবার্থ চিন্তামণি ইত্যাদি।
৩. রামেন্দ্র ভট্টাচার্য্য : জন্ম- লাউতা। গ্রন্থ: মীরাবাঈ, রামপ্রসাদ ইত্যাদি ।
৪. সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য : জন্ম- নয়াগ্রাম। গ্রন্থ: সমাজচিত্রে পঞ্চখণ্ড, আসামে মহাপ্লাবণ, India Under The British Crown.
৫. রামানন্দ মিশ্র : জন্ম- সুপাতলা। গ্রন্থ: রসত বিলাস।
৬. সত্যরাম : জন্ম – সুপাতলা। গ্রন্থ: ঘাটু সঙ্গীত, ধুয় বা ধুরা।
৭. সতীশচন্দ্র দেব : জন্ম- লাউতা। গ্রন্থ: নীতি সন্দর্ভ সংকলন।
এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, বিয়ানীবাজার শুধু একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, বরং তা একটি প্রজ্ঞাধর্মী জনপদ—যেখান থেকে উপমহাদেশের ইতিহাস ও সাহিত্যের অনেক বর্ণময় অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
এই ধারার পুনরুত্থানের ধারাবাহিকতায় বিয়ানীবাজারে সাংবাদিকতার শুরুর ইতিহাস সামনে চলে আসে।
বিয়ানীবাজারের সাংবাদিকতার বীজ রোপিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগেই। পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি, কৃষ্ণপ্রিয়া চৌধুরাণী, সতীশচন্দ্র দেব প্রমুখ মনীষীগণ সাহিত্যের পাশাপাশি সাংবাদিকতায় রেখেছেন গৌরবময় অবদান।
🔹লাউতা গ্রামের প্রতীথযশা সাংবাদিক সতীশ চন্দ্র দেব ছিলেন ‘জন্মভূমি’ ও ‘শ্রীভূমি’ নামক দুই ঐতিহাসিক পত্রিকার সম্পাদক। ‘জন্মভূমি’ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে সিলেট থেকে—একটি জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিক হিসেবে। ‘শ্রীভূমি’, করিমগঞ্জ থেকে ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁরই সম্পাদনায়।
🔹ক্ষিরোদচন্দ্র দেব, একজন স্বনামধন্য কলামিস্ট, ‘সুরমা’, ‘জনশক্তি’ ও ‘শ্রীভূমি’ পত্রিকায় কাজ করতেন।
🔹পণ্ডিতপাড়া গ্রামের তুষারপণ্ডিত ছিলেন বিবিসির কলকাতা প্রতিনিধি এবং ভারতের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক।
🔹 কাকুরা গ্রামের রাধানাথ চৌধুরী ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘পরিদর্শক’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
□ বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা ও প্রেক্ষাপট :
সাংবাদিকতা জাতির বিবেক—যা ইতিহাসকে ধারণ করে, সমাজকে জাগায়, রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে এবং মানবিকতা ও ন্যায়বিচারের পথে আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে। সেই মহৎ পেশার এক প্রাচীন ঘাঁটি বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব। বাংলাদেশের মফস্বল অঞ্চলের প্রথম প্রেসক্লাব— “বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব”।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সংবাদপত্রের বিকাশ ও সমাজদর্শনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। যার জন্ম ১৯৮২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের হাত ধরে। তিনি ছিলেন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
স্থানীয় সাংবাদিকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠিত এই সংগঠনটি সময়ের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও বিয়ানীবাজারের সংবাদজগতে ঐতিহ্য বহন করে চলছে।
□ ধারাবাহিক নেতৃত্ব ও সাংবাদিকতার প্রতিধ্বনি :
সাংবাদিকতা একটি জাতির চিন্তা, চেতনা ও চরিত্রের প্রতিফলন। এই ভূখণ্ডের প্রতিটি শিকড়ে, প্রতিটি উচ্চারণে সত্যের সন্ধান যেমন ছিল, তেমনি ছিল কলমের সাহস ও বিবেকের দৃঢ়তা। বিয়ানীবাজার শুধু শিক্ষায়-সাহিত্যে নয়, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এক ঐতিহ্যবাহী ও মর্যাদাবান জনপদ।
১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন গণমাধ্যমবান্ধব ও পেশাদার নেতৃত্বধারীরা। অতীত ও বর্তমান নেতৃত্বে যারা বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের নাম-তালিকা ক্লাবের গৌরবগাথার দলিল। ক্লাবের স্বচ্ছতা ও ঐতিহ্য রক্ষায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের পূর্ণাঙ্গ একটা তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
□ বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম থেকে শুরু করে আব্দুর রহীম, খালেদ সাইফুদ্দীন জাফরী, আব্দুর রউফ খান মিস্টু, , আতাউর রহমান, সজীব ভট্টাচার্য—এদের নেতৃত্বে প্রেসক্লাব এগিয়েছে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধের পথে। তাই সকলের জ্ঞাতার্থে সেই তালিকা নিম্নে উপস্থাপন করা গেল :
● ১৯৮২-৮৩: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম (সভাপতি) ও আব্দুর রউফ খান মিস্টু (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৮৩-৮৪: আব্দুর রহীম (সভাপতি) ও মো: মিছবাহ উদ্দিন (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৮৫-৮৭: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম (সভাপতি) ও আব্দুল বাসিত (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৮৯-৯০: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম (সভাপতি) ও ফারুক যোশী (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৯১-৯২: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম (সভাপতি) ও মুস্তাফিজ শফি (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৯২-৯৩: আব্দুর রহীম (সভাপতি) ও আজিজুল পারভেজ (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৯৪-৯৫: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম (সভাপতি) ও আব্দুর রহীম (সাধারণ সিম্পাদক)
● ১৯৯৯-২০০০: খালেদ সাইফুদ্দীন জাফরী (সভাপতি) ও আলী আহমদ বেবুল (সাধারণ সিম্পাদক)
● ২০০১-২০০৩: খালেদ সাইফুদ্দীন জাফরী (সভাপতি) ও ফজলুল হক (সাধারণ সিম্পাদক)
● ২০০৩-২০০৫: আব্দুর রহীম (সভাপতি) ও মো: আতাউর রহমান (সাধারণ সিম্পাদক)
● ২০০৫-২০১১: আব্দুর রউফ খান মিস্টু (সভাপতি) ও মো: আতাউর রহমান (সাধারণ সিম্পাদক)
● ২০১২-২০২০: মো: আতাউর রহমান (সভাপতি) ও মিলাদ মো: জয়নুল ইসলাম (সাধারণ সিম্পাদক)
● ২০২১- বর্তমান: সজীব ভট্টাচার্য (সভাপতি) ও মিলাদ মো: জয়নুল ইসলাম (সাধারণ সিম্পাদক)
প্রেসক্লাবের স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষায় এ বার্তাটি সকলের জন্য প্রাসঙ্গিক। প্রয়োজনে মতান্তর নিরসনে এক টেবিলে বসা উচিত। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সুস্পষ্ট বার্তা হচ্ছে—
“কে ছোট সাংবাদিক, কে বড় সাংবাদিক—তা বিবেচ্য নয়; সবচেয়ে প্রয়োজন ঐক্য, বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈতিকতার সুরক্ষা।”
□ চ্যালেঞ্জ ও বার্তা :
বিভিন্ন সময় মতবিরোধ, আঞ্চলিকতা ও বিভাজনের কারণে প্রেসক্লাবটি বারবার সংকটে পড়েছে। এ পেশার মর্যাদা রক্ষায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ঐক্য, স্বচ্ছতা ও সাংবাদিকতার মান রক্ষা। প্রেসক্লাবকে ঘিরে মতান্তর থাকতেই পারে কিন্তু মনান্তর রাখা উচিত নয়।
তাই প্রশাসন, সাংবাদিক সমাজ ও জনসাধারণের নিকট অনুরোধ—প্রেসক্লাবের বৈধ নেতৃত্ব গ্রহণ ও সহানুভূতির সাথে নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করা দায়িত্বশীলদের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব।
🇧🇩 মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা:
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তবাংলা, জয়বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, জন্মভূমি প্রভৃতি পত্রিকা এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার গৌরবময় চিত্র আঁকে।
➤’সাপ্তাহিক মুক্তবাংলা’: প্রকাশ হতো আসামের করিমগঞ্জ থেকে। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি: এইচ. সা’আদত খান (ছদ্মনাম: আবুল হাসনাত এ.এইচ.)। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম। এই পত্রিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সবচেয়ে সুসংগঠিত প্রচারমাধ্যমগুলোর একটি।
➤ ‘সাপ্তাহিক জয়বাংলা’ – সহকারী সম্পাদক: মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত (ছোটদেশ)
➤ ‘সোনার বাংলা’ – ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত(ছোটদেশ)
➤ ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ – সম্পাদক: আব্দুল মতিন চৌধুরী (আলীনগর)
➤’জন্মভূমি’ – সম্পাদক: মোস্তফা আল্লামা (দেউলগ্রাম)
□ সাংবাদিকদের অবদান ও বর্তমান চিত্র:
জাতীয় পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতায় সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিয়ানীবাজারকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তারা হলেন:
আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম (দৈনিক আজাদ), মুক্তিযুদ্ধকালীন দায়িত্ব: মুক্তবাংলা সাপ্তাহিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আব্দুল হাকিম তাপাদার (আল-ইসলাহ), বোরহান উদ্দিন খান (সাবেক সভাপতি, সিলেট প্রেসক্লাব), মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত (ইত্তেফাক প্রতিনিধি), শালেশ্বর গ্রামের বাহাউদ্দিন (মর্নিং সান), লোকমান আহমদ: দৈনিক আজকের সিলেট সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, এম.এ. তারিক (অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি): সাপ্তাহিক প্রহর সম্পাদক, ডা. নিবেদিতা দাস পুরকায়স্থ ও রাখি দাস পুরকায়স্থ: ‘চিহ্ন’ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ ও ‘নন্দিনী মালিয়া’ ছদ্মনামে সংবাদে লেখালেখি।
এছাড়াও স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা পেশায় যারা নিয়োজিত থেকে বিয়ানীবাজারকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তাদের মধ্যে দৈনিক যুগভেরী পত্রিকার কবি শামসাদ হুসাম, দৈনিক সংবাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শহীদুল ইসলাম, দৈনিক সমকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরবর্তীতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার স্টাফ রিপাের্টার আজিজুল পারভেজ, কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদ (দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি), দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার স্টাফ রিপাের্টার শাহজাহান কমর প্রমুখের কর্মনাম উল্লেখযোগ্য।
প্রেসক্লাব কেন্দ্রিক বিয়ানীবাজারের সাংবাদিকতায় আশির দশকের প্রথমদিকে সাংবাদিকতায় আসেন আব্দুল হাছিব, আব্দুর রউফ খান মিষ্ঠু, মিসবাহ উদ্দিন, রণজিৎ চক্রবর্তী, হেলাল উদ্দিন, আব্দুর রহীম, আব্দুল আজিজ, আলী ঈসমাইল, দেলোয়ার হোসেন জিলন, কবি ফজলুল হক, শাকুর মজিদ, খালেদ জাফরী প্রমুখ।
নব্বই ও পরবর্তী দশকে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: মুস্তাফিজ শফি, আজিজুল পারভেজ, আতাউর রহমান, বাবুল হোসেন, আব্দুল কাদির মুরাদ, আব্দুল্লাহ আল আনসারি, শাহজাহান কমর, আলী আহমদ বেবুল, জয়নাল আফসার, রেজওয়ান আহমদ, আব্দুল খালিক, শরিফুল হক মঞ্জু, হিরন রোহী দাস, এম হাসানুল হক উজ্জ্বল, এম সাত্তার আজাদ, ফয়জুল হক শিমুল, সজীব ভট্টাচার্য, মুকিত মুহাম্মদ, আব্দুল ওয়াদুদ, এনায়েত হোসেন সোহেল, শাহীন আলম হৃদয়, মিলাদ মো. জয়নুল ইসলাম, মোঃ জাকির হোসেন, ছাদেক আহমদ আজাদ।
তারও পরবর্তী সময়ে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তারা হলেন: হাসান শাহরিয়ার, শাবুল আহমদ, মাসুম আহমদ, মনোয়ার হুসেন লিটন, ফয়সল মাহমুদ, আহমেদ ফয়সাল, ফুজেল আহমদ, জহির উদ্দিন, সুফিয়ান আহমদ, শিপার আহমদ পলাশ, এ টি এম আবু তুরাব, সুয়াইবুর রহমান স্বপন, মোঃ জসিম উদ্দিন, সামিয়ান হাসান, রেজাউল হক, তোফায়েল আহমদ, সৈয়দ মুনজের হোসেন বাবু, আহমদ রেজা চৌধুরী, এম এ ওমর, আবুল হাসান, শহিদুল ইসলাম সাজু, আমিনুল হক দিলু, সাকের আহমদ, রুহেল আহমদ, হাফিজুর রহমান তামিম প্রমুখ।
সময়ের স্রোতে অনেকেই পেশা বদল করেছেন, কেউ প্রবাসে গেছেন। তবে এখনো বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও স্থানীয় সংবাদপত্রের ধারায় অগ্রসর হচ্ছেন অনেকে, নতুনদেরও আগমন ঘটছে।
□ সাংবাদিকতা হোক সততার প্রতিচ্ছবি:
একজন সংবাদসেবী হিসেবে কিংবা প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বুঝেছি—সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়, এটি নৈতিক দায়বদ্ধতা ও সমাজের দর্পণ। আমরা যারা কলম হাতে সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লিখি, সত্য প্রকাশে নির্ভীক থাকি—তাদের দায়িত্ব আরও অনেক বেশি।
কিন্তু কষ্ট হয়, যখন দেখি কিছু মানুষ সাংবাদিকতার নামে অপ-সাংবাদিকতা করছেন। নিজেদের স্বার্থে কলম চালাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন এবং বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি করছেন। যারা নিজেদের মনোমালিন্য বা ভিন্নমতের কারণে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন—তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই পথে কারও কল্যাণ কোনদিন হয় নাই। আর বিভক্তি কখনোই শক্তি হতে পারে না।
আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রেসক্লাব কোনো ব্যক্তির নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান—যেখানে সাংবাদিকদের রক্ত, ঘাম ও স্বপ্ন লেগে আছে। এ প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, ব্যক্তিগত মতানৈক্য পেছনে ফেলে, পেশাগত সততা ও সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে সবাইকে এক ছায়াতলে ফিরে এসে ভ্রাতৃত্ববোধে কাজ করা উচিত।
□ কেন ঐক্য, বস্তুনিষ্ঠতা ও দায়িত্বশীলতা জরুরি :
বিয়ানীবাজারের সাংবাদিকতা কেবল সংবাদ প্রকাশ নয়—এটি ইতিহাস রক্ষার, দেশপ্রেমে সত্য বলার, সামাজিক বিবেক জাগিয়ে তোলার এক দীপ্ত পরিক্রমা। এ নিরিখে দেশ, জাতি ও জনমত গঠনে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিহার্য। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক সময় মফস্বল সাংবাদিকরা শারীরিক নিপীড়নের শিকার হন, হন অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র, হামলা-মামলার টার্গেট। আবার কারো চাকরি চলে যায়, জীবন জীবিকায় আসে টানাপোড়েন। নানা ছলচাতুরির জালে তারা হন নানাভাবে হয়রানির শিকার।
তবে মনে রাখতে হবে—সাংবাদিকতা বিভাজনের নয়, এটি ঐক্যের জায়গা। সাংবাদিকদের ক্ষেত্র হচ্ছে সংবাদপত্র। এটি মেধা ও মননের শিল্পভিত্তিক চর্চাস্থল—যেখানে সত্য প্রকাশই প্রধান ব্রত। এই শিল্পকে কলুষিত করা, বিভ্রান্তি ছড়ানো কিংবা মতলববাজির প্ল্যাটফর্ম বানানো সাংবাদিকতার প্রতি চরম অবিচার।
আর প্রচারমাধ্যমের তদারকি কাজে যিনি থাকেন, তিনি শুধু সম্পাদক কিংবা তত্ত্বাবধায়ক নন, তিনিকে বিচারকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে হয়। যদি তিনি আইনজ্ঞানহীন হন, নীতিহীন হন, দলীয় লোকের তাবেদারি করেন—তবে যেমন একজন বিচারকের রায়ে ন্যায়বিচার অসম্ভব, তেমনি একজন অসৎ সম্পাদক/সিইও সমাজের সঠিক পাঠ ও পাঠককে বিভ্রান্ত করেন।
সাংবাদিকের কাজ কোনো রাজনৈতিক দালালি নয়, তোষামোদ নয়—বরং কলমের শাণিত শক্তিতে সমাজকে জাগিয়ে তোলা। সাংবাদিক যদি এর বত্যয় করেন, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তিনিই করেন নিজেকে। তাই ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট—যেকোনো মিডিয়ায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছুই কাম্য হতে পারে না।
সাংবাদিকতা হবে মুক্ত বিবেকের প্রতিচ্ছবি। শব্দ দিয়ে গড়া এই পেশা যেন সমাজের দর্পণ হয়ে ওঠে—সেটাই হোক আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্য।
□ উপসংহার:
বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি একটি চিন্তাশীল সংবাদ-ঐতিহ্যের ধারক।
➤বার্তা:
প্রেসক্লাবকে ঘিরে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু মনভেদ থাকা উচিত নয়।
বিভ্রান্তি নয়, ঐক্যের আলোয় বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব হোক সকলের গৌরবের ঠিকানা।
বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব তার চার দশকের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাফল্যের মধ্য দিয়ে আজও সে ঐতিহ্য বহন করছে। আগামী দিনেও পেশাদার সাংবাদিকদের নেতৃত্বে বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব সত্যের পক্ষে, সমাজের স্বার্থে ও ইতিহাসের গৌরবে এগিয়ে যাবে—এ প্রত্যাশা সবার।