বিয়ানীবাজারের হৃদয়ে এক জলাধার নিয়ে টানাপোড়েন
✍️ আতাউর রহমান
বিয়ানীবাজার পৌরশহরের কেন্দ্রস্থলে একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক পুকুরের অস্তিত্ব অনেক পুরনো। এই পুকুর শুধুমাত্র একটি জলাধারই নয়, এটি শহরের পরিবেশগত ভারসাম্য, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এই পুকুরটিকে ঘিরে একের পর এক বিতর্ক, লীজ বাণিজ্য এবং অবৈধ দখলের অভিযোগ উঠে আসছে।
২০১৭ সালে যখন এই পুকুর ভরাট করে সেখানে বহুতল মার্কেট নির্মাণের খবর প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই সচেতন নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে সরব হয়। সেই সময় থেকেই একটি যৌক্তিক দাবি উঠে আসে—এই পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে এটিকে একটি দৃষ্টিনন্দন পার্কে রূপান্তর করা হোক, যেখানে শহীদ মনু মিয়া, ডঃ জি সি দেব, শহীদ কমর উদ্দিন, শহীদ জামাল কিংবা আং মান্নান রেফারীর স্মরণে ‘শহীদ স্মৃতি পার্ক’ গড়ে তোলা যেতে পারে।
গত ঈদের পর থেকে আবারও এই এলাকায় অন্তত পাঁচটি অবৈধ দোকান নির্মাণের অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে—জেলা পরিষদের মালিকানাধীন সরকারি খতিয়ানভুক্ত পুকুর ও তার আশপাশের জায়গা কি শুধুই কিছু সুবিধাভোগীর লীজ বাণিজ্যের মাঠ হবে, নাকি জনগণের যৌক্তিক চাহিদার জায়গা হবে?
● জনতার দাবি
১২ জুলাই ২০২৫ তারিখে গণঅধিকার ফোরামের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করা হয়েছে:
১. সরকারি পুকুরসমূহ দখলমুক্ত করে পরিচ্ছন্ন ও জনবান্ধব ব্যবহারের উপযোগী করা।
২. পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ।
৩. অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ।
এই দাবিগুলো একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, অন্যদিকে নাগরিকদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার প্রতিও গুরুত্বারোপ করে।
● প্রশাসনের ভাষ্য
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি অবগত হয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন এবং জানিয়েছেন নতুন করে কোনো লীজ নবায়ন হয়নি। জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কাউকে দোকান নির্মাণের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেইনি। অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ কথাগুলো আশাব্যঞ্জক হলেও বাস্তবে এই সরকারি জমিতে একের পর এক দোকান নির্মাণ, লীজ বাণিজ্য ও পরিবেশ বিনাশ—সবই দৃশ্যমান। ফলে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন জাগে—এই পুকুর কার? জনসাধারণের, নাকি কিছু সুবিধাভোগী চক্রের?
● প্রবাসীর স্বপ্ন, নাগরিকের প্রত্যাশা
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিয়ানীবাজারবাসী ছরওয়ার হোসেন ‘শহীদ স্মৃতি পার্ক’ নামে একটি জনমুখী প্রস্তাব রেখেছেন। শুধু তিনি নন, দেশ-বিদেশের অনেক বিয়ানীবাজারবাসীই চান শহরের প্রাণকেন্দ্রটি একটি সবুজ, নির্মল, স্মৃতিময় ও পারিবারিক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হোক।
● উপসংহার: এখনই সময়—পুকুর রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার
আমরা কি এমন একটি শহর গড়তে পারি না যেখানে নদী-নালা-পুকুর থাকবে জীবন্ত? যেখানে মানুষ হাঁটবে ওয়াকওয়েতে, বাচ্চারা খেলবে শিশুপার্কে, প্রবীণরা বসবে বেঞ্চে আর সবাই মিলে স্মরণ করবে শহীদদের?
এই পুকুর আজ শুধু একটি জায়গা নয়, এটি এখন পরিবেশ সচেতনতা, স্মৃতির মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের প্রতীক। তাই পুকুর নয়, এখানে চাই ‘শহীদ স্মৃতি পার্ক’। এটি শুধু চাহিদা নয়, সময়ের দাবি—ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মূল্যবান উপহার।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাব।