দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর একদিন বাকি। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন। এ নির্বাচন সামনে রেখে সিলেটের নির্বাচনী মাঠে বিশেষ প্রার্থীকে জিতিয়ে দেয়ার তৎপরতায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন একাধিক ভাগে বিভক্ত। সিলেটের ৬টি আসনের মধ্যে সিলেট-১ ও সিলেট-৪ দুই মন্ত্রীর এ দুটি আসনে শক্তিশালী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তবে সিলেট-২, সিলেট-৩, সিলেট-৫ ও সিলেট-৬ আসনের ভোট এরই মধ্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে বিশেষ নজরে রয়েছেন তৃণমূল বিএনপির শমসের মুবিন চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হুছামুদ্দীন চৌধুরী। শেষ মুহুর্তে এসে বিশেষ প্রার্থীদের কেটলি মার্কায় ও সোনালি আঁশ প্রতীকের প্রচারণায় প্রকাশ্যে অংশ নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ ঘরানার নেতাকর্মীরা। এসব আসনেও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল প্রার্থী রয়েছেন। এ চারটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য।
সিলেটের এ চারটি আসনে নৌকার প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার ভোটে ভাগ বসালেও প্রার্থিতা বহাল রাখতে তাকে বারবার যেতে হয়েছে আদালতে। ফলে নির্বাচনী প্রচারে তিনি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন।
সিলেট-৩ আসনের বর্তমান এমপি ও নৌকার প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব রয়েছেন বেকায়দায়। এই আসনের এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে হাবিব বিজয়ী হয়ে বেশ আলোচনায় আসেন। নির্বাচনের প্রথম দিকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এই হিসাব পাল্টে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল। তিনি ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। এরই মধ্যে ডা. দুলাল তার জনসভায় হাবিব-সমর্থকদের হামলার অভিযোগ এনেছেন। এতে করে ট্রাক প্রতীকে ভোটের রব উঠেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ হয়ে ভোট চাইছেন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য আবু জাহিদসহ স্থানীয় অনেক নেতৃবৃন্দ।
সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে অনেকটা হাল ছেড়ে বসে আছেন নৌকার প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ। নেতাকর্মীদের বিভক্তির কারণে এলাকায় নির্বাচনী পরিবেশ নেই বলে তিনি ইসিতে লিখিত অভিযোগ করলেও পরে তা ফিরিয়ে নিয়েছেন। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আহমদ আল কবির। তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনিও দাবি করেন, সরকারি একটি পক্ষ একজন বিশেষ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। কানাইঘাট উপজেলা সদরে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হুসাম উদ্দিনের সমর্থকরা জানিয়েছেন- গত বৃহস্পতিবার রাতে হামলা চালিয়ে একটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে প্রতিপক্ষ। এদিকে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ সক্রিয় আনজুমানে আল ইসলাহের সভাপতি হুছামুদ্দীন চৌধুরীকে নিয়ে। নৌকার বাইরে এসে তারা হুছামুদ্দীনের কেতলি প্রতীকে প্রচার ও গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হুছামুদ্দীন চৌধুরীর প্রয়াত বাবা আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী সারাদেশে ‘ফুলতলী হুজুর’ হিসেবে পরিচিত। আবদুল লতিফের তৈরি করা সংগঠন আনজুমানে আল ইসলাহের অসংখ্য ভক্ত ও মুরিদ আছেন। ইতিমধ্যে গেল ৫ ডিসেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে হুছামুদ্দীন চৌধুরীর সাক্ষাৎ আলোচনার পর নির্বাচনী মোড় ঘুরে যায়। হুছামুদ্দীনকে সমর্থন দিয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ কেটলি প্রতীকের পক্ষে প্রচার মিছিল করেছে। উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও কাজলসার ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা হুছামুদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে কাজ করছেন। কেটলি প্রতীকের মিছিলে নেতৃত্ব দিছেন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সুলতান আহমদ। শেষের দিকে নির্বাচনী পরিবেশ নেই এমন অভিযোগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাব্বীর আহমদ।
সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থী দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পক্ষে রয়েছেন বড় অংশের নেতারা। তবে নতুন করে আরেকটি অংশ স্বাধীনতার পক্ষে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে সোনালী আঁশ প্রতীকে ভোট প্রার্থনায় তৃণমূল বিএনপি’র প্রার্থী শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে রয়েছেন। তাঁর পক্ষে সক্রিয় রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরী এলিম, সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের আরেক সদস্য ও বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মোহাম্মদ জাকির হোসেন, গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুবিন আহমদ জায়গিরদার, জিল্লুর রহমান, রুকন উদ্দিন, আবুল ফজল চৌধুরী শাহেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক খুরশেদ আলম চৌধুরী রিপন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রুহেল আহমদ, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি রুহিন আহমদ খান, আমুড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাছিন আহমদ চৌধুরী মিন্টু, আওয়ামীলীগ নেতা হাবীবুর রহমান রাহেল(প্রাক্তন মেম্বার), বিয়ানীবাজার উপজেলা যুবলীগ নেতা ইকবাল হোসেন, গোলাপগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোওয়ার হোসেন দীপন, উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ফরিদ উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদক নাসিম আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি মঞ্জিল আহমদ চৌধুরী, শহীদ পরিবারের সন্তান নজরুল হোসেন, সমাজসেবক আহমদ মহসিন বাবর, আলী আহমদ বদরুস সালাম-সহ অনেক নেতাই ভোট চাইছেন সোনালি আঁশ প্রতীকে। এছাড়াও ফুলতলী অনুসারী আনজুমানে আল ইসলাহের নেতাকর্মীরা সোনালি আঁশ প্রতীকের হয়ে প্রচারণা করছেন। প্রচারণায় গোলাপগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে শমসের মবিন চৌধুরীর পক্ষে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। নৌকা প্রার্থীর বিপরীতে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সরওয়ার হোসেনও ভোটের মাঠে বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। তার পক্ষে ঈগল প্রতীকের প্রচারণায় রয়েছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ওয়েছুর রহমান, বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি হোসেন আহমদ, সাবেক ভিপি সরোয়ার আহমদ, বিয়ানীবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জাকারিয়া আহমেদ পাপলু, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল বারী, গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আবুল লেইস, দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সম্পাদক সাহাব উদ্দিন, সদস্য এমএ ওয়াদুদ এমরুল, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপ-পানিসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক জামিল আহমদ প্রমুখ।
এ আসনে নির্বাচনী প্রচারণার শেষ মুহূর্তে ভোটারদের মাঝে নৌকা, সোনালী আঁশ ও ঈগল প্রতীকের উত্তাপ ছড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে চার বারের নির্বাচিত এমপি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নৌকার প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ কতটা সামলিয়ে উঠতে পারবেন, ভোটের বাজারে এই আলোচনাই চলছে।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, এসব প্রচারণায় কোনো বাধা নেই। এ ব্যাপারে কঠিন কোনো নির্দেশনাও নেই। তবে নৌকা আওয়ামী লীগের প্রতীক, নৌকার বিজয় হবেই।
এদিকে- সিলেটে ভোটের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে ইতিমধ্যে ১৩টি উপজেলা ও একটি সিটি করপোরেশন এলাকায় ক্যাম্প বসিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা টহলে রয়েছে। পাশাপাশি বিজিবি’র পক্ষ থেকেও প্রতিটি উপজেলায় ক্যাম্প বসানো হয়েছে। ভোটে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী ও সমর্থকরা এবং ভোটের বাইরে থাকা বিরোধী রাজনৈতিক জোটের কর্মীরা যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটাতে পারে, সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক অবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।