লেখক Π আতাউর রহমান
নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনো বিলাসিতা নয়, একটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন প্রবণতায় সাধারণ মানুষ যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতির মুখে—সে বিষয়গুলো তথ্যের আলোকে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চিত্র উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬,৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৭,২৯৪ জন নিহত ও ১২,০১৯ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় নারী নিহতের হার প্রায় ১২-১৩% এবং শিশু নিহতের হার ১৫-১৬%। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, বাংলাদেশের রাস্তার মাত্র ২-৫% অংশ তিন তারকা বা তার বেশি নিরাপত্তা মানে পৌঁছেছে। এসব তথ্যই প্রমাণ করে, সড়ক অবকাঠামো, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহন খাতের দৌরাত্ম্য দ্রুত কাঠামোগতভাবে মোকাবিলা না করলে মানুষের জীবন আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ঘাটতি আরেকটি বড় প্রশ্ন। ঢাকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচার প্রক্রিয়ার দেরি ও অকার্যকারিতার কারণে প্রায় ৭০% মানুষ মব জাস্টিসকে সমর্থন করছে। এর ফলে বিচারবহির্ভূত সহিংসতা বেড়ে গেছে এবং সাধারণ মানুষ আইনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। “Justice fails, mobs rise”—এই বাস্তবতা এখন বাংলাদেশে দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে মানুষ অপরাধীর হাত থেকে যেমন অরক্ষিত, তেমনি ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা থেকেও বঞ্চিত।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও জনমানসে নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এর ইনক্লুসিভ নির্বাচনের সম্মতি না দেওয়ায় রাজনৈতিক আস্থা সংকট কাটছে না। নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও তা মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। কারণ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নিশ্চয়তা নিয়ে এখনো গুরুতর সংশয় রয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুনভাবে আলোচনায় আসা পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতির প্রশ্ন। অনেকের মতে, এটি অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে পারে, তবে অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন করলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও সাধারণ মানুষের জীবনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে ক্রমাগত ঝুঁকিতে রাখছে। চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়ের চাপ অনেকের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্যসেবায় অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং চিকিৎসকের স্বল্পতা মানুষকে আরও অরক্ষিত করছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যও শহরমুখী হতে হচ্ছে, যা সামাজিক নিরাপত্তা জালকে দুর্বল প্রমাণ করছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও তাপপ্রবাহে প্রতিবছর লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় দুর্যোগ পরবর্তী অনিশ্চয়তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ শুধু দুর্যোগের সময়ই নয়, পরবর্তীতেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ আংশিক সুরক্ষিত হলেও পূর্ণ নিরাপত্তা অর্জন করতে পারেনি। আইন-শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করতে হবে; সড়ক পরিবহন খাতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে; অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন না করলে মানুষের নিরাপত্তার অনুভব ফিরে আসবে না। নাগরিকের নিরাপত্তা কোনো দয়া নয়—এটি তাদের মৌলিক অধিকার, যা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে।