
আতাউর রহমান
লোকসংগীতের ভুবনে অনেকেই আলোচনার কেন্দ্রে থাকেন, আবার অনেকেই থাকেন নীরবে—শুধু সাধনায়। তেমনই এক নিরব সাধকের নাম শাহ ছাব্বির আহমদ মানিক, যিনি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘সিঙ্গার মানিক’ নামে। খ্যাতির পেছনে না ছুটে, মাটির গন্ধ মেখে তিনি আজীবন আগলে রেখেছেন বাউলিয়ানা ও লোকসংস্কৃতির বাতিঘর।
শেকড় ও পরিচয়
১৯৭৯ সালের ২ মার্চ জন্ম নেওয়া শাহ ছাব্বির আহমদ মানিকের পৈতৃক নিবাস সিলেটের বৈরাগী বাজার এলাকার খশির (নতুন পাড়া) গ্রামে। পিতা প্রয়াত মৌলানা আমিন উদ্দিন, মাতা ছাফারুন বেগম। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্রে ও ছোট ভাই যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও, তিনি আরেক ভাই মায়ের সঙ্গেই দেশে থাকেন।
তাঁর সংসারে রয়েছে তিন সন্তান—দুই ছেলে ও এক মেয়ে। একজন ছেলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত, অপরজন বিদেশগমনে প্রত্যাশী। একমাত্র মেয়ে ডিগ্রি পর্যায়ে পড়াশোনা করছে।
শৈশবেই বাউলিয়ানা
বৈরাগী বাজার এলাকায় স্থানীয় বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন মানিক। পড়াশোনার পাশাপাশি খুব অল্প বয়সেই তাঁর মনে দানা বাঁধে গানের প্রতি গভীর আকর্ষণ। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতেই রেকর্ডার শুনে শুনে গান তোলা, বাউলদের আনাগোনায় মুগ্ধ হওয়া—এসবই তাঁকে ধীরে ধীরে টেনে নেয় বাউলিয়ানার পথে।
১৪ বছর বয়সে নানীর সঙ্গে ভারতের দশনলি এলাকায় যাওয়ার সময় তাঁর জীবনে আসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। নানীর বাড়ির পাশের একটি স্কুলে শিলং থেকে আগত শিল্পী নিতাই চন্দ্র রায়–এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সেখানে কয়েকটি গান গেয়ে প্রশংসা পান, যা তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।
সংগ্রামের সুর
বিয়ানীবাজারের বিলবাড়িস্থ আব্দুল আহাদ মিয়ার বাড়িতে আনসার ভিডিপি ক্লাবে লুকিয়ে লুকিয়ে হারমনি চর্চা করতেন তিনি।
“গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ”—এই গান দিয়েই শুরু হয় তাঁর হারমনির যাত্রা। চামচ-প্লেট দিয়ে তাল ধরা, নিজের মতো করে লয় শেখা—এসবই ছিল তাঁর সংগীত শিক্ষার পাঠশালা।
তবে পরিবারে বিষয়টি জানাজানি হলে পড়াশোনা ও গানের পথে আসে কঠোর বাধা। একসময় সুনামগঞ্জের দিরাই গিয়ে আশ্রয় নেন বাউল সম্রাট আব্দুল করিম–এর সান্নিধ্যে। করিম সাহেব আদর করে গান গাইতে উৎসাহ দিলেও, প্রতিষ্ঠার পথে কোনো শক্ত হাত তিনি পাননি।
তোষামোদ নয়, আত্মসম্মান
মানিক স্পষ্ট ভাষায় বলেন—
“উপরে ওঠার সিঁড়িতে কেউ হাত বাড়ায়নি। তোষামোদ করতেও যাইনি। কষ্ট নিয়ে, শ্রম দিয়ে নিজেকেই গড়ে তুলেছি।”
এই আত্মমর্যাদাই তাঁকে আলাদা করে চিনিয়েছে।
পল্লীবাউল লোক সংগীতালয়
২০০৪ সালের ৩ নভেম্বর বৈরাগী বাজারে প্রতিষ্ঠা করেন পল্লীবাউল লোক সংগীতালয় (পিবিএলএস) ক্যালচারাল একাডেমি। এখান থেকে অনেক শিল্পী উঠে এলেও, নানা প্রতিবন্ধকতায় খুব বেশি দূর যেতে পারেননি তারা। তবুও গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির ধারক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান আজও একটি পরিচিত নাম।
ফেসবুকে ‘Singer Manik’ আইডির মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
ক্রীড়াঙ্গনেও সক্রিয়
সংগীতের পাশাপাশি তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠক। আঞ্চলিক খেলোয়াড় তৈরি, দল গঠন ও স্থানীয় খেলাধুলায় তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
এক স্মরণীয় পথচলা
কানাইঘাটের লোভাছড়া এলাকায় বাউল গান শেষে কটালপুর ফেরার পথে মোটরবাইক বিকল হয়ে পড়া—এই ঘটনাটি তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, যা আজও তিনি হাসি ও বেদনার মিশেলে স্মরণ করেন।
লক্ষ্য ও দর্শন
মানিকের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—
নিজের জন্য নয়, দেশপ্রেমিক ও গুণী মানুষ তৈরি করা।
নতুন প্রতিভা অন্বেষণ ও লালন করাই তাঁর ব্রত।
পরিবার থেকে গানের বিষয়ে তেমন সমর্থন না পেলেও, এলাকার বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতাই তাঁর প্রতিষ্ঠানের মূল শক্তি।
উপসংহার
লোকসংগীতের এই সময়ের ভিড়ে শাহ ছাব্বির আহমদ মানিক এক ব্যতিক্রমী নাম। তিনি প্রচারের আলো নয়, বেছে নিয়েছেন সাধনার পথ। তাঁর জীবনগাথা প্রমাণ করে—সংগ্রাম, নিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদা থাকলে লোকসংস্কৃতির প্রদীপ নিভে যায় না।