
আতাউর রহমান
কিছু মৃত্যু কেবল একটি মানুষের জীবনাবসান নয়—সেগুলো সময়কে স্তব্ধ করে দেয়, সমাজকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু তেমনই এক গভীর বেদনার নাম। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধাদের চোখে তিনি ছিলেন এক সাহসী কণ্ঠ, এক নির্ভীক সংগঠক—যিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতি মানুষের জন্য, ক্ষমতার জন্য নয়।
ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা ছিল তার রাজনৈতিক বিশ্বাসেরই প্রকাশ। এটি কোনো ক্ষমতালোভের ঘোষণা ছিল না; ছিল রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার এক আন্তরিক প্রয়াস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই পথচলাই হয়ে উঠল তার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায়।
১২ ডিসেম্বর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওসমান হাদির জীবন-মৃত্যুর লড়াই শুরু হয়। স্বজনদের চোখে তখন ছিল উদ্বেগ, সহযোদ্ধাদের হৃদয়ে ছিল প্রার্থনা, আর সাধারণ মানুষের মনে ছিল একটাই আশা—তিনি ফিরে আসবেন। উন্নত চিকিৎসার আশায় তাকে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। কিন্তু সব আশা ভেঙে দিয়ে ১৮ ডিসেম্বর তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
এই মৃত্যু আমাদের হৃদয়ে শুধু শোক নয়, এক গভীর অসহায়তাও রেখে যায়। একজন রাজনৈতিক কর্মী, একজন প্রার্থী—তিনি কেন নিরাপত্তাহীন হবেন? কেন মত প্রকাশ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এতটা ভয়ংকর হয়ে উঠবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা।
ওসমান হাদির মৃত্যু একটি পরিবারকে নিঃস্ব করেছে, সহযোদ্ধাদের করেছে দিশেহারা, আর সমাজকে করেছে আরও অনিশ্চিত। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি রাজপথে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতেন, ভয়কে অগ্রাহ্য করতেন। তার সেই মানবিক সাহসই হয়তো তাকে শত্রুর চোখে কাঁটা করে তুলেছিল।
এই শোকের মুহূর্তে আমরা কেবল শোক প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করতে পারি না। রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায় হলো—এই হত্যাকাণ্ডের সত্য উদঘাটন করা, দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং ভবিষ্যতে যেন কোনো ওসমান হাদিকে এভাবে প্রাণ দিতে না হয়, সে পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ওসমান হাদি নেই—কিন্তু তার স্বপ্ন, তার লড়াই আর মানুষের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস রয়ে গেছে। শোকের এই অন্ধকারে সেটুকুই হয়তো আমাদের একমাত্র আলোর দিশা।