1. news@panchakhandaeye.com : পঞ্চখণ্ড আই : পঞ্চখণ্ড আই
  2. info@www.panchakhandaeye.com : পঞ্চখণ্ড আই :
শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:১২ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ :
ডাকসুর শত বছরের ইতিহাস: আন্দোলন, নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকার Π আতাউর রহমান দারুল হাদিস লতিফিয়া মাদরাসার পক্ষ থেকে দুই ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা স্মারক প্রয়াত খলিলুর রহমান চৌধুরীর স্মরণে আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল ডাকসু নির্বাচন: অভিযোগ-উত্তেজনার মাঝেই শিবির সমর্থিত জোটের নিরঙ্কুশ জয় ডাকসু নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা: উপাচার্যকে ‘জামায়াতি প্রশাসন’ আখ্যা ছাত্রদলের সিলেটে পাহাড় ও টিলা কাটায় কঠোর ব্যবস্থা: প্রকৃতি রক্ষায় প্রশাসনের নির্দেশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এডহক ও নিয়োগ কমিটি গঠনের নির্দেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন: শিক্ষার্থীদের আস্থায় পরিবর্তনের সুর, কড়া নিরাপত্তায় ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি উত্তর বিয়ানীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির আহবায়ক কমিটি গঠন রাজনীতির মাঠে শাইলক চরিত্র ও ঐক্যের পরীক্ষা

ডাকসুর শত বছরের ইতিহাস: আন্দোলন, নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকার Π আতাউর রহমান

আতাউর রহমান
  • প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

আতাউর রহমান :

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে অমর নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ—ডাকসু। এই সংসদকে অনেকে বলেন দেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’। কারণ, ডাকসুর ভেতর থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব শুধু ক্যাম্পাস নয়, প্রভাব রেখেছে জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি বাঁকে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের গণআন্দোলন—প্রতিটি ঐতিহাসিক সংগ্রামে ডাকসু দিয়েছে নেতৃত্ব, প্রভাব রেখেছে জাতীয় রাজনীতিতেও।

● সূচনায় ডাকসু

১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেশের আধুনিক উচ্চশিক্ষার নতুন যাত্রা। প্রতিষ্ঠার পরপরই তৎকালীন রেজিস্ট্রার স্যার এ. এফ. রহমানের উদ্যোগে তিনটি আবাসিক হলে—মুসলিম হল, জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল—ছাত্র সংসদ গঠিত হয়। এই আবাসিক হল সংসদগুলোই পরবর্তীতে রূপ নেয় বৃহত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে (Dacca University Student’s Union)।

● নামকরণের বিবর্তন

প্রথম দিকে একে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ বলা হলেও, তখনও “ডাকসু” নামটি প্রচলিত হয়নি। প্রায় তিন দশক পর এসে নামকরণ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (Dhaka University Central Students’ Union)।

ডাকসুর নাম নিয়ে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জমান তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন:

“এখন সবাই বলে ডাকসু। তার অনুকরণে রাকসু, চাকসু, জাকসু, ইউকসু ইত্যাদি চলছে। অথচ আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ১৯৫৩ সালে, তখন ডাকসুর নামও শুনিনি। কিছুদিন পর শুনলাম। এর পেছনের ইতিহাস অনেক পুরনো।”

১৯২২–২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র সংসদ গঠিত হয়। প্রত্যেক হল থেকে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি, একজন শিক্ষক প্রতিনিধি এবং উপাচার্যের মনোনীত একজন শিক্ষককে নিয়ে সংসদ গঠিত হতো। শিক্ষকদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি নির্বাচিত হতেন।

● প্রাথমিক কার্যক্রম ও ভূমিকা

সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম দুই দশকে ছাত্র সংসদের কর্মকাণ্ড ছিল মূলত জ্ঞানচর্চা, আত্মোন্নয়ন এবং সমাজসেবামূলক।

➤ তারা পরিচালনা করত সান্ধ্য বিদ্যালয়।
➤ খেলাধুলা ও শরীরচর্চার আয়োজন করত।
➤ বস্তিবাসীদের মধ্যে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করত।
➤ বন্যা ও মহামারির সময় ত্রাণকাজ করত।
➤ প্রতি শনিবার হলে অনুষ্ঠিত হতো আলোচনা সভা ও বিতর্ক, যেখানে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ জাতীয় রাজনীতির বিষয়েও আলোচনা হতো।

তবে লক্ষ্যণীয় যে, তখনকার ডাকসুর নেতারা কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি অনুসারী ছিলেন না, যদিও ব্যক্তিগতভাবে দলের প্রতি সমর্থন ছিল।

● নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা

১৯৪৪–৪৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করে। তার অধীনে ১৯৪৫–৪৬ সালে উপাচার্য পি. জে. হার্টগ পদাধিকারবলে ছাত্র সংসদের সভাপতি হন। ছাত্রদের মধ্যে সহ-সভাপতি হন আহমেদুল কবির (পরবর্তীতে সংবাদ সম্পাদক) এবং সাধারণ সম্পাদক হন সুধীর দত্ত। ১৯৪৭–৪৮ সালে সহ-সভাপতি হন জগন্নাথ হলের অরবিন্দ বসু, সাধারণ সম্পাদক হন গোলাম আযম। পরে গোলাম আযমের বদলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন এ. জেড. খান (পরবর্তীতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক)। তাদের কার্যকালের মেয়াদ ১৯৫০ সালে শেষ হলে আর নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

অবশেষে ১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করে। তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ—ডাকসু। এভাবেই ডাকসুর আত্মপ্রকাশ ঘটে দেশের শিক্ষাজীবন ও জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে। ডাকসু আত্মপ্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত মোট ৩৭ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন।

● স্বাধীনতার আগে: নেতৃত্বের ভাঁটি

স্বাধীনতাপূর্ব ডাকসু নির্বাচনে উঠে আসা অনেক নেতাই হয়ে ওঠেন পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ এবং জিএস হন ছাত্র ইউনিয়নের কাজী আরেফ। ১৯৫৬ সালের নির্বাচনে ভিপি হন আবদুর রাজ্জাক ও জিএস হন সিরাজুল আলম খান। দুজনই মুক্তিযুদ্ধপূর্ব রাজনৈতিক আন্দোলনে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা।
১৯৫৮ সালে ভিপি হন তোফায়েল আহমেদ এবং জিএস হন আব্দুল কুদ্দুস মাকনুল। ষাটের দশকে ১৯৬২ সালের নির্বাচনে আবার ভিপি হন আবদুর রাজ্জাক ও জিএস হন আ স ম আবদুর রব। ১৯৬৬ সালের নির্বাচনে ভিপি হন তোফায়েল আহমেদ এবং জিএস হন আ স ম আবদুর রব। ১৯৬৯ সালের উত্তাল সময়ে নির্বাচিত ভিপি তোফায়েল আহমেদ ও জিএস শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছাত্র নেতৃত্বে পরিণত হয়।

● স্বাধীনতার পর: গণতন্ত্রের পাঠশালা

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। সেবার ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস হন মাহবুবুর জামান।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হন জাসদ-ছাত্রলীগ জোটের মাহমুদুর রহমান মান্না (ভিপি) এবং আখতারুজ্জামান (জিএস)। পরের বছর আবারও একই নেতৃত্ব জয়ী হলেও তাঁরা এবার ছিলেন বাসদ-ছাত্রলীগের ব্যানারে।
১৯৮২ সালে ভিপি হন আখতারুজ্জামান, জিএস হন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ১৯৮৯ সালে ভিপি হন ছাত্রলীগের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, জিএস হন জাসদ ছাত্রলীগের মুশতাক আহমেদ। আর ১৯৯০ সালের আন্দোলনমুখর সময়ে ডাকসুর নেতৃত্ব আসে ছাত্রদলের হাতে—ভিপি হন আমানউল্লাহ আমান, জিএস হন খায়রুল কবির খোকন।

● হারানো ধারাবাহিকতা

১৯৯১ সালের পর দীর্ঘ সময় নির্বাচন হয়নি। একাধিকবার তফসিল ঘোষণা হলেও ছাত্ররাজনীতির দ্বন্দ্ব ও সরকারের অনীহায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে কমিটি ভেঙে দিলেও ঘোষিত নির্বাচন বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০৫ সালেও একই পরিণতি হয়। এরপর নানা আন্দোলন হলেও ডাকসু নির্বাচন কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।

● ২৮ বছর পর ভোটের উত্তাপ

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হন, আর জিএস হন ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী। দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাব নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়।

● শতবর্ষে ২০২৫-এর ডাকসু

দীর্ঘ বিরতির পর শতবর্ষে ২০২৫-এ এসে ডাকসুর ৩৭তম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৪৭১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ৪৫ জন, জিএস পদে ১৯ জন এবং এজিএস পদে ২৫ জন। নারী প্রার্থী ছিলেন ৬২ জন।

তবে এবারের নির্বাচনে একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো—বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অংশগ্রহণ করেনি। স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসুর নেতৃত্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের অনুপস্থিতি তাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।

ঘোষিত ফলে দেখা যায়, ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। ভিপি পদে মো. আবু সাদিক (সাদিক কায়েম) ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৮৪ ভোট, আরেক স্বতন্ত্র উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট।

১০ সেপ্টেম্বর সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ফল ঘোষণা করা হয়।

● সামনে কী?

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা—২০২৫ সালের এই নির্বাচন ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আর ছাত্রলীগের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও জাতীয় রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব তৈরির ভাঁটি হিসেবে ডাকসু আবারও ফিরে পাবে তার ঐতিহাসিক মর্যাদা।

Leave a Reply

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট