
বিয়ানীবাজারে দ্বিতীয় বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো জুঁই প্রকাশ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। গত শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী বিয়ানীবাজার পৌর শহরের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে আয়োজিত এই সম্মেলনে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাহিত্য অনুরাগীরা অংশ নেন।
দিনব্যাপী এই আয়োজন সাহিত্য আড্ডা, কবিতা পাঠ, আলোচনা সভা ও মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সম্মেলনটি সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলায় রূপ নেয়, যেখানে দুই দেশের লেখকদের ভাবনা, ভাষা ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক উঠে আসে আলোচনায়।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ভারত থেকে আগত কবি ড. তৈয়বুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, দু’দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য এক অভিন্ন ঐতিহ্যের ধারক। সাহিত্যই পারে সীমান্তের ভৌগোলিক বিভাজন অতিক্রম করে লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে। এই ধরনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন দুই বাংলার সাহিত্যিকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতাকে আরও গভীর করে।
প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন দেশ এডিশন পত্রিকার সহ সম্পাদক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক আতাউর রহমান। তিনি বলেন, “জুঁই প্রকাশ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন”–এর মতো একটি মননশীল আয়োজনে কথা বলাটা গভীর দায়বদ্ধতার বিষয়। তাঁর বক্তব্যে তিনি সাহিত্যের নৈতিক দায়িত্ব, সত্য ও মানবতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, সাহিত্য মানুষের বিবেক জাগ্রত করে, প্রশ্ন করতে শেখায় এবং অন্ধকার সময়ে আলোর পথ দেখায়। শব্দের অপব্যবহারের এই সময়ে সাহিত্যকে হতে হবে আরও সচেতন ও সংবেদনশীল। তিনি উল্লেখ করেন, এই সম্মেলনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে, কারণ এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে শহীদ শরিফ ওসমান হাদীর সম্মানার্থে ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক দিবসে। এই দিনে সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের অর্থ হলো—শোককে নীরবতায় সীমাবদ্ধ না রেখে সচেতন চিন্তা ও মানবিক প্রতিরোধে রূপ দেওয়া।
তিনি আরও বলেন, তরুণদের লেখালেখিতে জনপ্রিয়তার চেয়ে সত্য ও মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। লেখা মানে কেবল প্রকাশ নয়, লেখা মানে অবস্থান নেওয়া—ন্যায়, সহনশীলতা ও মানবতার পক্ষে।
আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন লোকজ কবি ওয়ালি মাহমুদ। তিনি পঞ্চখণ্ডের পুরাতন সাহিত্য–সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বলেন, পঞ্চখণ্ড অঞ্চল একসময় বাংলা সাহিত্যের নীরব কিন্তু সমৃদ্ধ এক জনপদ ছিল। এখানকার লোকসাহিত্য, পুঁথি, গান, পালাগান ও মৌখিক কাব্যচর্চা মানুষের জীবনযাপন, বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে গভীরভাবে ধারণ করে রেখেছে। এই অঞ্চলের সাহিত্যধারা মূলত গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের ভাষা থেকে জন্ম নিয়েছে, যা আজও আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

জুঁই প্রকাশ–এর কর্ণধার কবি আজিজ ইবনে গণি’র সভাপতিত্বে O হেপি জান্নাতের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশগ্রহণ করেন কবি বিমল কর, সাংবাদিক আজিজুর রহমান জয়নাল, বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি ফয়জুল হক শিমুল, বিয়ানীবাজার জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন এর সভাপতি ও প্রসক্লাব সদস্য সাংবাদিক এম এ ওমর, কবি আতাউর রহমান নোমান, ছড়াকার শেখ তাজ উদ্দিন আহমদ, শিক্ষক সাকিব মাহবুব, শিক্ষক মোঃ আল মামুন, সাংবাদিক সালেহ আহমদ, কবি হামিদা বেগম ঝুমা-সহ বিয়ানীবাজারের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যান্য কবি ও লেখকবৃন্দ।
আলোচনায় জুঁই প্রকাশ–এর কর্ণধার কবি আজিজ ইবনে গণির ভূমিকার প্রশংসা করে বক্তারা বলেন, তাঁর নেতৃত্বে জুঁই প্রকাশ আজ কেবল একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সাহিত্যিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। সম্পাদনাসহ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩৬টি, যা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

সম্মেলনে এছাড়াও একাধিক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—কবি আজিজ ইবনে গণির ‘বাউলা (২য় খণ্ড)’, ‘সেই ছেলেটি’ ও ‘গুণীজনের কথা’, কাজি এম হাসান আলীর ইসলামি কাব্যগ্রন্থ ‘নাজাত’, কবি সুহেনা আক্তার হেনার ‘শব্দের ভেতর আমি’, এম এ চৌধুরী হাছিবের ‘বাবার লাঠি’সহ অন্যান্য লেখকের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং দুই দেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা আরও দৃঢ় করে।
আয়োজকরা জানান, ভবিষ্যতেও নিয়মিতভাবে এমন সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনের মাধ্যমে সাহিত্যপ্রেমী ও লেখকদের একত্রিত করার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে—যাতে বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ ও মানবিক হয়ে উঠতে পারে।