
মানুষের জীবনে কিছু ভাঙন আছে যা শব্দ করে না—কিন্তু চিরে যায় গভীর ভেতরে। মোবাইল ফোন পড়ে ভাঙলে শব্দ হয়, স্ক্রিনে দাগ দেখা যায়; কিন্তু সম্পর্কের ভাঙন নিঃশব্দে ঘটে, অদৃশ্য এক ফাটল সৃষ্টি করে। আর সেই ফাটলই সবচেয়ে ভয়ংকর—কারণ মেরামত করা গেলেও আগের মতো স্বচ্ছতা আর কখনোই ফেরে না। আমরা হয়তো স্ক্রিন পাল্টাই, কেসিং বদলাই, সফটওয়্যার রিসেট করি; তবুও ভাঙার স্মৃতি কোথাও জমে থাকে, সাড়া দেয়, মনে করিয়ে দেয়—আগের মতো সার্ভিস আর পাওয়া যাবে না।
সম্পর্কের ভাঙনও ঠিক এমনই। যতবারই চেষ্টা করি জোড়া লাগানোর, যতবারই ক্ষমা চাই বা ক্ষমা করি—হৃদয়ের কোনো এক কোণে পুরোনো কষ্টের ছায়া রয়ে যায়। সম্পর্ককে আবার চালু করা যায়, ব্যবহার করা যায়, এমনকি সুন্দরভাবেও চালানো যায়—কিন্তু আগের সেই সারল্য, সেই স্বাভাবিকতা, সেই নির্ভেজাল অনুভূতি কখনোই পুরোপুরি ফিরে আসে না। কারণ বিশ্বাসের স্ক্রিন একবার ভাঙলে, তার চিহ্ন থাকে আজীবন।
অনেকেই ভাবে, বাহ্যিক সৌজন্য বা হাসিমুখই নাকি মেরামত। কিন্তু সম্পর্কের সফটওয়্যার নষ্ট হলে শুধু বাহির ঠিক করলে সমাধান হয় না। গভীরে জমে থাকা অভিমান, না-বলা যন্ত্রণা, ভুল বোঝাবুঝির ছাই—সেগুলো যতক্ষণ না পরিষ্কার হয়, ততক্ষণ কোনো নতুন স্ক্রিনই স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। ঠিক যেমন নতুন ডিসপ্লে লাগানো ফোন দ্রুত গরম হয়ে যায়, হঠাৎ হ্যাং করে—নতুন করে জোড়া লাগা সম্পর্কও তেমনি নাজুক হয়ে ওঠে।
তবুও সম্পর্ক মেরামত অর্থহীন নয়। বরং সেখানে জন্ম নেয় পরিণতি, সতর্কতা, পরস্পরের অনুভূতির প্রতি নতুন করে সম্মান। কিন্তু যে সত্যটি মেনে নিতে হয়—যা একবার ভেঙেছে, তা আর কখনোই একেবারে নতুন থাকে না।
জীবনের এই কঠিন পাঠ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়: যত্নের ঘাটতি, অবহেলার ক্ষত এবং আচরণের আঘাত—এসবই সম্পর্কের স্ক্রিনে চির ধরায়। তাই ভাঙার পরে মেরামতের চেয়ে ভাঙার আগেই রক্ষা করাটাই সবচেয়ে জরুরি। কারণ স্ক্রিন পাল্টানো যায়, কিন্তু ভাঙার স্মৃতি আর কোনোদিনই পাল্টায় না।
লেখক: আতাউর রহমান, শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও সমাজচিন্তক।