🔷 নবায়ন ছাড়াই বছরের পর বছর চলছে ক্লিনিক ব্যবসা
🔷 অদক্ষ নার্সের হাতে নবজাতকের মৃত্যুতে ক্ষোভ
🔷 প্রশাসনের অভিযানে জরিমানা ও কারাদণ্ড
পঞ্চখণ্ড আই প্রতিবেদক :
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় লাইসেন্সবিহীন ও মানহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে অবাধ চিকিৎসা বাণিজ্য, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
● অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানে অবাধ চিকিৎসা-বাণিজ্য
বিয়ানীবাজার পৌর শহর ও আশপাশের এলাকায় নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক, ডেন্টাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এলাকায় ৬টি হাসপাতাল ও ১২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। তবে এর অধিকাংশের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ বা নবায়নবিহীন। অনেকেই “নবায়নের আবেদন কপি” দেখিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ক্লিনিক মালিক জানান, প্রশাসনের জটিল শর্তের কারণে তারা সময়মতো লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়েই অনুমোদন ছাড়াই ক্লিনিক পরিচালনা করছেন।
● অদক্ষ নার্সের হাতে নবজাতকের মৃত্যু
সম্প্রতি গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমকোনা গ্রামের সৌদিপ্রবাসী আব্দুল হামিদের স্ত্রী প্রসববেদনা নিয়ে স্থানীয় এক ক্লিনিকে ভর্তি হলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই অদক্ষ নার্স প্রসব করানোর চেষ্টা করেন। দীর্ঘ সময়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর একটি মৃত নবজাতকের জন্ম হয়।
স্বজনদের অভিযোগ, “অভিজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অদক্ষ নার্সের জোরাজুরির কারণেই নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে।”
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং বিয়ানীবাজার থানায় লিখিত অভিযোগও করা হয়।
● প্রশাসনের অভিযান: প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও জরিমানা
এরই মধ্যে প্রশাসনও অবৈধ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ৫ অক্টোবর (শনিবার) বিয়ানীবাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ফিজিওথেরাপি সেন্টার’ সিলগালা করা হয়। অভিযান চলাকালে প্রতিষ্ঠানটি বৈধ কাগজপত্র প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া একই এলাকায় অবস্থিত মুক্তি থেরাপি সেন্টারকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রদর্শনের নির্দেশ দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
এ অভিযানে প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মুস্তাফা মুন্না। তিনি জানান—
“বেস্ট সার্জিক্যাল অ্যান্ড ফিজিওথেরাপি সেন্টারে যিনি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন, তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সনদ বা প্রশিক্ষণ নেই। অনুমোদন ছাড়াই এই চর্চা চালিয়ে আসছিলেন, যা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।”
তিনি আরও বলেন,
“সংবাদ পেলেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ অভিযান চলবে।”
● ভুয়া ডাক্তার ও অনিয়ন্ত্রিত সেবা
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠানে ভুয়া বা প্রশিক্ষণহীন চিকিৎসক ও নার্স দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এতে রোগীরা যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
● স্বাস্থ্য বিভাগ ও চিকিৎসক সমাজের মতামত
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দীন বলেন—
“অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানো সম্পূর্ণ অবৈধ। দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সময়মতো লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে, অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিয়ানীবাজার চিকিৎসক পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাহিদ আহমেদ তুহিন বলেন—
“স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় জরুরি। কিন্তু মানহীন ও লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান চালানোর সুযোগ দেওয়া যাবে না। নিয়মিত মনিটরিং ও মূল্যায়নের মাধ্যমে এই খাতকে স্বচ্ছ ও আস্থাশীল করতে হবে।”
● পরিত্রাণের পথ: নিয়মিত তদারকি ও সচেতনতা
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখন প্রয়োজন কঠোর প্রশাসনিক নজরদারি, স্বচ্ছ নীতিমালা বাস্তবায়ন ও জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসায় নয়, দায়িত্বের জায়গা থেকে পরিচালিত হওয়া দরকার— তাহলেই এ বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ সম্ভব।