Π আতাউর রহমান:
“শিক্ষকতা ছিল তাঁর সাধনা, শিক্ষার্থী ছিল তাঁর পরিবার” — এ কথাটিই যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় কাজি মতিউর রহমান স্যারের জীবনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন একাধারে এক আদর্শ শিক্ষাগুরু, এক মানবিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাক্ষেত্রে এক নিরলস যোদ্ধা।
তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ ও শিক্ষা বিস্তারের এক বিরল উদাহরণ। ব্যক্তিত্বে ছিলেন দৃঢ়, তবে হৃদয়ে ছিলেন কোমল ও স্নেহময়। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর পিতৃসুলভ শাসন আর বন্ধুসুলভ আচরণ তাঁকে করে তুলেছিল অনন্য। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন সিলেট এম. সি. কলেজের প্রথম নির্বাচিত ভিপি।
Π জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি :
১৯৪২ সালের ২৬ নভেম্বর, বিয়ানীবাজার উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নের ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কাজি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা তৈয়বুর রহমান ছিলেন একজন এল.এম.এফ পাশ ডাক্তার এবং মাতা কমরুন নেছা একজন স্নেহময়ী গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
Π শিক্ষাজীবনের বাঁকবদল :
ডিব্বই শহরের কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা। দেশ বিভাগের পর দেশে ফিরে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর হরগোবিন্দ হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন।
পড়াশোনার পথে একাধিকবার বিরতি এলেও তিনি থেমে থাকেননি। কখনো অসুস্থতা, কখনো রাজনৈতিক আন্দোলন, আবার কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা দ্বন্দ্ব তাঁর শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে।
তবুও তিনি শিক্ষার আলো জ্বালাতে পিছপা হননি। শেষমেশ ডিগ্রি পাস করে শিক্ষা বিস্তারের মহান কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
Π কর্মজীবনে দীপ্ত পদচারণা :
জালালপুর হাই স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু তাঁর কর্মজীবন। এরপর ফকিরের বাজার হাই স্কুল, লাউতা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সবশেষে বিয়ানীবাজার আদর্শ বিদ্যানিকেতন— প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন পথপ্রদর্শক, সংগঠক ও উন্নয়নের কারিগর।
১৯৮৫ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর এই প্রতিষ্ঠানকে তিনি নিজ হাতে গড়েছেন। পরবর্তী সময়ে শিল্পপতি খলিলুর রহমান চৌধুরীর আর্থিক সহায়তায় এটি “খলিল চৌধুরী আদর্শ বিদ্যানিকেতন” নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালে স্বীকৃতি ও ১৯৯৪ সালে এমপিওভুক্তি লাভ— সবই তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অধ্যবসায় ও দৃষ্টিভঙ্গির ফল। উল্লেখ্য, এমপিওভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত তিনি একই সাথে লাউতা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেন।
২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করলেও শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নেতৃত্বের যে আলো তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা আজও আলোকিত করছে শিক্ষাক্ষেত্র।
Π একটি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি :
লেখক হিসেবে আমার নিজের ২১ বছরের শিক্ষকতা জীবনের সিংহভাগ কেটেছে এই মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তাঁর স্নেহ, দিকনির্দেশনা ও আদর্শিক অনুশাসন আমার পেশাদার জীবনের পথনির্দেশ হয়ে রয়েছে।
Π মহাপ্রস্থান:
২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর এই গুণী শিক্ষক ইহলোক ত্যাগ করে চিরপ্রস্থানে যান। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি, শিক্ষা ও নীতি আমাদের অন্তরে অম্লান হয়ে আছে।
তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
“একজন সত্যিকারের শিক্ষকের চলে যাওয়া যেন একটি যুগের অবসান।”