বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায়, ফজরের নামাজের পর তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিএনপি মিডিয়া সেল ও দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পৃথক পোস্টে তার ইন্তেকালের খবর নিশ্চিত করা হয়। পোস্টে বলা হয়, দেশনেত্রীর রূহের মাগফিরাত কামনা করা হচ্ছে এবং তার বিদেহী আত্মার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘ চিকিৎসা ও সংকটময় অবস্থা
গত ২৩ নভেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থা অত্যন্ত জটিল এবং তিনি সংকটময় সময় পার করছিলেন।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট, দিনাজপুর জেলায়। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার এবং মা তৈয়বা মজুমদার। শৈশবে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন।
১৯৬০ সালে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং নানা সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
রাজনীতিতে পদার্পণ ও নেতৃত্ব
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের পর দলের সংকটময় সময়ে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়।
এরপর ১৯৮৩ সালে ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ‘আপসহীন নেত্রী’
আশির দশকে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। আপসহীন সংগ্রামের কারণে তিনি পরিচিতি পান ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে।
স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার দৃঢ় অবস্থান থেকে তিনি সাত দলীয় জোট গঠন করেন। এই আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তাকে সাতবার গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দী করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শিক্ষা খাতে যুগান্তকারী সংস্কার আনেন। এর মধ্যে— বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, উপবৃত্তি কর্মসূচি, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীতকরণ—উল্লেখযোগ্য।
বিরোধী দল ও দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরা
১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও তিনি ১১৬টি আসন নিয়ে সংসদের বৃহত্তম বিরোধী দলীয় নেত্রী হন।
১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠন করেন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ২৯তম স্থানে স্থান দেয়।
তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে কোনো নির্বাচনী আসনে পরাজিত না হওয়ার বিরল রেকর্ডের অধিকারী। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যেসব আসনে নির্বাচন করেছেন, সবগুলোতেই বিজয়ী হন।
এ ছাড়া ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি স্টেট সিনেট গণতন্ত্রের পক্ষে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘গণতন্ত্রের যোদ্ধা’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মামলা, কারাবরণ ও খালাস
২০১৮ সালে একটি বিতর্কিত মামলার রায়ে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দেশি-বিদেশি বহু আইন বিশেষজ্ঞ এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেন এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে সব মামলায় তিনি খালাস পান।
জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি
দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার ইন্তেকালে দেশের রাজনীতি এক অভিভাবকতুল্য নেত্রীকে হারাল (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯