রিভিউ:আতাউর রহমান
সমকালীন কবিতায় যেসব কণ্ঠ ব্যক্তি-যন্ত্রণা থেকে সমাজচিন্তার দিকে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে, কবি সুহেনা আক্তার হেনা তাঁদের অন্যতম। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “শব্দের ভেতর আমি” সেই অভিযাত্রারই স্পষ্ট দলিল—যেখানে ‘আমি’ কেবল ব্যক্তি নয়, বরং সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ানো এক মানবিক সত্তা।
২০২৫ সালে জুঁই প্রকাশ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি বিয়ানীবাজার, সিলেট থেকে প্রকাশিত। মোট ৩২ পৃষ্ঠায় ২৬টি কবিতা নিয়ে গ্রন্থটি আকারে ছোট হলেও বিষয় ও বক্তব্যে যথেষ্ট বিস্তৃত। প্রকাশনায় জুঁই প্রকাশ, বৈরাগীবাজার; প্রচ্ছদে শাহ অনিরুদ্ধ রোদ্দুরের নান্দনিক ভাবনা, কম্পোজে তাহের ইবনে গণির যত্ন এবং মুদ্রণ তত্ত্বাবধানে ইক্বরা কম্পিউটারের সমন্বিত প্রয়াস বইটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।
কবি ও তাঁর প্রেক্ষাপট
কবি সুহেনা আক্তার হেনা একজন উদীয়মান কবি, সমাজকর্মী ও নারী উদ্যোক্তা। জন্ম ৭ নভেম্বর, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার আমনিয়া গ্রামে। পিতা প্রয়াত চেরাগ মিয়া। শৈশব থেকেই সাহিত্য ও মানবসেবার প্রতি অনুরাগী এই কবি বিশ্বাস করেন—“কলমই পারে মনুষ্যত্বের আলো ছড়িয়ে দিতে।”
তিনি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের জীবন সদস্য এবং সমাজসেবায় মানবিক ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবায় যুক্ত। নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও তিনি সমাজে সক্রিয়। ভ্রমণ ও বই সংগ্রহ তাঁর প্রিয় শখ। বাংলাদেশসহ বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রসার যোগ করেছে। পাঠকমহলে তিনি ‘প্রিন্সেস হেনা’ নামেও পরিচিত।
গ্রন্থের বিষয় ও ভাবনা
“শব্দের ভেতর আমি” মূলত মানবিক চেতনা, সামাজিক বৈষম্য, রাষ্ট্রচিন্তা, দেশপ্রেম ও আত্মসংঘাতের কাব্যিক প্রকাশ। সূচীপত্রের কবিতাগুলোতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবির সামাজিক অবস্থান—
“সবার ঊর্ধ্বে মানব প্রেম”, “মানবতা হারিয়ে গেছে”, “রাষ্ট্রের পরিবর্তন চাই”, “সুবিধাবাদী বন্ধু”, “ধান্দাবাজীর দল”—এসব কবিতায় কবি সমাজের ভণ্ডামি, সুবিধাবাদ ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ।
একই সঙ্গে ব্যক্তিগত অনুভূতির কবিতাও গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে। এ বইয়ের দুটো কবিতা “হাজারো স্বপ্নের মৃত্যু” কবিতায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও “তোমাকে ভুলবো না হে মুক্তিযুদ্ধ” কবিতায় ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত।
হাজারো স্বপ্নের মৃত্যু : এয়ি এক আর্তনাদের কবিতা
সুহেনা আক্তার হেনার কবিতা “হাজারো স্বপ্নের মৃত্যু” সমকালীন জীবনের স্বপ্নভঙ্গ, নিঃশব্দ যন্ত্রণা ও আত্মসংকটের এক গভীর দলিল। ব্যক্তিগত বেদনার ভেতর দিয়েই কবি তুলে ধরেছেন সামষ্টিক বাস্তবতা—যেখানে মানুষ বেঁচে থাকে, অথচ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে তার স্বপ্ন ও প্রেরণা।
কবিতার শুরুতেই অন্তর্গত যন্ত্রণার তীব্রতা পাঠককে নাড়া দেয়—ভেতরে প্রবল কষ্ট, বাইরে নীরবতা।
“বাস্তবতার কাছে আমার স্বপ্ন হয়েছে জব্দ”—এই পঙক্তিতে ফুটে ওঠে বর্তমান মানুষের অসহায়ত্ব ও স্বপ্নবন্দিত্ব।
কবিতার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন—
“আচ্ছা মানুষ কিভাবে স্বপ্ন ছাড়া বাঁচে?”
এটি কবিতাকে আবেগের গণ্ডি ছাড়িয়ে অস্তিত্বগত অনুসন্ধানে নিয়ে যায়।
যদিও কবিতাজুড়ে বিষণ্নতার আধিক্য এবং রূপকের সীমিত ব্যবহার কিছুটা একঘেয়েমি তৈরি করে, তবু কবির আবেগী সততা ও অন্তর্গত উচ্চারণ কবিতাটিকে শক্ত ভিত দেয়।
সব মিলিয়ে “হাজারো স্বপ্নের মৃত্যু” স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে ঘিরে লেখা এক আন্তরিক ও সাহসী কবিতা—যা পাঠককে নিজের ভাঙা স্বপ্নগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে।
ভাষা ও শৈলী
কবির ভাষা সহজ, প্রাঞ্জল ও বক্তব্যনির্ভর। তিনি অলংকারের চেয়ে অনুভবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এতে সাধারণ পাঠক সহজেই কবিতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তবে কোথাও কোথাও বক্তব্যের সরাসরিত্ব কাব্যিক গভীরতাকে কিছুটা সীমিত করেছে। রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার আরও বিস্তৃত হলে কবিতাগুলো দীর্ঘস্থায়ী শিল্পমূল্য অর্জন করতে পারত। ছন্দের ক্ষেত্রেও কিছু কবিতায় পরিমার্জনের সুযোগ রয়ে গেছে।
উৎসর্গ ও দায়বদ্ধতা
গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির গুরুজন জনাব এম এ মতিন (বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী)-কে। এই উৎসর্গ কবির চিন্তা ও চেতনার ভিত্তিকে স্পষ্ট করে—যেখানে শিক্ষা, মানবিকতা ও সমাজসেবার মূল্যবোধ গভীরভাবে প্রোথিত।
মূল্যায়ন
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯