পঞ্চখণ্ড আই প্রতিবেদক :
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হলো নিরাপদ ও সুষ্ঠু বাসস্থান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শহর ও পৌর এলাকার ভাড়াটিয়ারা প্রায়ই এক অঘোষিত জিম্মি জীবনের শিকার। অধিকাংশ বাড়িওয়ালারা মাসিক ভাড়া আদায় করেন রশিদ ছাড়া, কোনো লিখিত চুক্তি ছাড়াই বছরের পর বছর ভাড়া বাড়িয়ে দেন, আবার অনেক সময় ইচ্ছেমতো ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদও করেন। ফলে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার সম্পর্কটি অনেক সময় অন্যায়ের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। বিয়ানীবাজার পৌরসভাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে, অথচ প্রশাসনিক তদারকি নেই বললেই চলে।
আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশে বাড়িভাড়া নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যমান ‘হাউস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১’-এর বিধান অনুযায়ী বাড়িভাড়া আদায়ের সময় রশিদ দেওয়া বাধ্যতামূলক। লিখিত চুক্তি ছাড়া ভাড়া নেওয়া বেআইনি, এবং ভাড়া বাড়ানোর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার কাছে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল থাকায় অন্যায় আচরণও সহ্য করতে বাধ্য হন।
অগ্রিম জরিমানা ও সংস্কারের অর্থ আদায়ের অভিযোগ
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কেউ যদি পারিবারিক বা চাকরিসংক্রান্ত প্রয়োজনে হঠাৎ বাসা ত্যাগ করতে চান, অনেক বাড়িওয়ালা তখন অগ্রিম এক মাসের ভাড়া জরিমানা হিসেবে আদায় করে থাকেন। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি ও অনৈতিক। তাছাড়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের খরচও ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের আচরণ শুধু আর্থিক শোষণ নয়, বরং মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। কারণ একজন ভাড়াটিয়া নিজের ইচ্ছায় বাসা ত্যাগ করার অধিকার রাখেন, যদি না কোনো চুক্তিবদ্ধ বাধ্যবাধকতা থাকে।
মানবাধিকার ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ
রশিদবিহীন লেনদেন ও স্বেচ্ছাচারী জরিমানা কেবল আইনের লঙ্ঘন নয়, এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রত্যেক মানুষের নিরাপদ আবাসনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ রশিদবিহীন ভাড়া, চুক্তিবিহীন উচ্ছেদ, অগ্রিম জরিমানা ও সংস্কার বাবদ অর্থ আদায়ের মাধ্যমে এই মৌলিক অধিকার ক্রমাগতভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আর্থিক সংকটে পড়ছে, সামাজিক স্থিতিশীলতাও ব্যাহত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি ও কর ফাঁকির চিত্র
এই অনিয়ন্ত্রিত বাড়িভাড়া প্রক্রিয়া অর্থনৈতিকভাবেও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। রশিদবিহীন ভাড়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ কর ব্যবস্থার বাইরে থেকে যায়। বাড়িওয়ালারা আয়কর ফাঁকি দেন, পৌরসভা বা স্থানীয় সরকার রাজস্ব হারায়, আর নগর অর্থনীতি এক ধরনের অস্বচ্ছ লেনদেনের জালে বন্দি হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাড়ার ক্ষেত্রে রশিদ বাধ্যতামূলক করলে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং নাগরিক পর্যায়ে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিয়ানীবাজার পৌরসভা প্রেক্ষাপট
বিয়ানীবাজার পৌরসভায় প্রতিনিয়ত বাড়িভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক মালিক লিখিত নোটিশ ছাড়াই ভাড়াটিয়াকে ঘর ছাড়ার নির্দেশ দেন, কেউ রশিদ চাইলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, আবার কেউ বাসা ছাড়তে চাইলে অগ্রিম এক মাসের ভাড়া বাবত জরিমানা দাবি করেন। পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও এখনো পর্যন্ত কোনো ভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন বা সচেতনতা কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে প্রশাসনের দায়িত্বশীল ভূমিকা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
সংস্কারের প্রস্তাব ও সমাধানের পথ
এই সমস্যার সমাধানে কয়েকটি সংস্কার জরুরি—
১. রশিদ বাধ্যতামূলক করা: প্রতিটি ভাড়ার জন্য নির্ধারিত ফরমে লিখিত রশিদ প্রদানের নিয়ম কার্যকর করা।
২. ভাড়ার নিবন্ধন: পৌরসভা বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রতিটি বাড়ির ভাড়ার তথ্য নিবন্ধিত করা।
৩. ভাড়াটিয়া সুরক্ষা বোর্ড: অভিযোগ গ্রহণ ও সালিশি নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ বোর্ড গঠন করা।
৪. কর আদায় ও স্বচ্ছতা: বাড়িভাড়ার ওপর কর আরোপের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনা।
ন্যায়বোধ ও মানবিকতার আহ্বান
ভাড়াটিয়া কেবল অর্থ প্রদানকারী নয়, তিনি একজন নাগরিক—যার মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় রাষ্ট্র ও প্রশাসনের জবাবদিহি থাকা জরুরি। রশিদবিহীন ভাড়া আদায়, ট্যাক্স ফাঁকি, স্বেচ্ছাচারী ভাড়াবৃদ্ধি, অগ্রিম জরিমানা ও সংস্কার বাবদ অর্থ আদায়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। বিয়ানীবাজার পৌরসভাসহ সারাদেশে এসব নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে নাগরিক জীবনে ন্যায়বোধ, স্বচ্ছতা ও আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯