পঞ্চখণ্ড আই প্রতিবেদক :
সিলেট জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এক ভয়াবহ বাস্তবতা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে— শিক্ষক আছেন, কিন্তু স্কুলে নেই। মাসের পর মাস ছুটি না নিয়েই অনেকে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। পরিবার নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার এই প্রবণতা এখন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, ফলে জেলার প্রায় সব উপজেলার বিদ্যালয়েই তীব্র শিক্ষক সংকট দেখা দিয়েছে। এই অনুপস্থিতির ফলে পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে।
২১ মাসে বিভাগীয় ব্যবস্থা ১৬৩ জনের বিরুদ্ধে
সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট ১৬৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪০ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়ে অধিকাংশকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাকিদের মামলা এখনও চলমান রয়েছে। অফিস সূত্র আরও জানায়, শিক্ষকরা চাকরি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ না করে বিদেশে চলে যাওয়ায় পদ শূন্যতা পূরণের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। এতে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়ছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
উপজেলাভিত্তিক অনুপস্থিতির চিত্র
প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ২১ মাসের তথ্য অনুযায়ী, ৬০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষকের উপজেলাভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়— বিশ্বনাথে ২৪ জন, বিয়ানীবাজারে ২০ জন, সিলেট সদরে ১৬ জন, বালাগঞ্জে ১১ জন, গোলাপগঞ্জে ১২ জন, ফেঞ্চুগঞ্জে ৪ জন, জকিগঞ্জে ১৬ জন, কানাইঘাটে ৭ জন, জৈন্তাপুরে ৪ জন, গোয়াইনঘাটে ১০ জন, দক্ষিণ সুরমায় ১৮ জন, ওসমানীনগরে ২০ জন এবং কোম্পানীগঞ্জে ১ জন শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন। এই তথ্য স্পষ্ট করে যে প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই শিক্ষক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
দেড় হাজারের বেশি পদ শূন্য
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের পরিচালক শাখাওয়াত এরশেদ বলেন, ছুটি ছাড়া ৬০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ ধরনের অভিযোগে ১৬৩ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, চাকরিচ্যুত করা গেলেও জরিমানা করার কোনো বিধান নেই। বর্তমানে সিলেট জেলায় প্রধান শিক্ষকের ৭৮৮টি ও সহকারী শিক্ষকের ৭৫০টি পদ শূন্য রয়েছে, যা এই সংকটের ভয়াবহতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
‘চাকরি না ছেড়েই প্রবাসে’—নতুন প্রবণতা
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অনেক শিক্ষক চাকরি থেকে ইস্তফা না দিয়েই ভ্রমণ বা কাজের ভিসায় পরিবারসহ বিদেশে চলে যাচ্ছেন। ফলে পদ খালি দেখানো যাচ্ছে না, যার কারণে নতুন শিক্ষক নিয়োগেও দেরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পেশা ছেড়ে বিদেশে
শিক্ষাবিদদের মতে, এই বিদেশমুখী প্রবণতা তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পেশাগত অনুপ্রেরণার অভাব এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীনতার কারণে। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, “সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কিছুটা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে তুলনা করলে তা যথেষ্ট নয়। তাই অনেকেই সুযোগ পেলেই বিদেশে চলে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ সুরক্ষার আশায়।”
আলোহীন পাঠশালার সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ
বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষকদের এই ধারাবাহিকতা যদি বন্ধ না হয়, তবে জেলার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক সংকটে পড়বে। একদিকে শিক্ষক সংকট, অন্যদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা—এই দুইয়ের ফাঁদে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিক্ষকহীন স্কুল মানে আলোহীন পাঠশালা। এই প্রবণতা রোধে সরকার, প্রশাসন ও সমাজ—সবারই দায়িত্বশীল ভূমিকা এখন সময়ের দাবি।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯