আতাউর রহমান, পঞ্চখণ্ড আই প্রতিবেদক:
চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে সিলেট জেলায় দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন বিপর্যয়। সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সামগ্রিকভাবে পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫১.৮৬ শতাংশ—অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর, ২০২৫) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বোর্ড কার্যালয়ে বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করেন।
ফলাফলের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাশের হার নিম্নমুখী হওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীর সাফল্যে আশার আলোও জ্বলছে।
বিয়ানীবাজারের ফলাফল চিত্র
বিয়ানীবাজার উপজেলায় মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ২,৩৭৬ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ১,৬৮৩ জন, ফলে পাশের হার ৭০.৮১ শতাংশ। উপজেলায় এ বছর একমাত্র বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের ২৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ অর্জন করেছে—যা পুরো উপজেলার মধ্যে সর্বাধিক। যদিও সামগ্রিকভাবে এ হার গত বছরের তুলনায় কিছুটা নিম্নমুখী।
উপজেলার সাতটি কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ পাসের হার ৭৭.১৯ শতাংশ, অর্জন করেছে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ। অন্যদিকে, বৈরাগীবাজার আইডিয়াল কলেজের পাসের হার ৪৯.৬৮ শতাংশ, আছিরগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২৯.৩৩ শতাংশ, দুবাগ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২৭.৯৯ শতাংশ, এবং সৈয়দ নবীব আলী কলেজে ২৬.৩২ শতাংশ।
সবচেয়ে দুর্বল ফলাফল করেছে বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজ (২২.৫৭%) এবং কুড়ারবাজার কলেজ (১৪.২৯%)।
পরিসংখ্যান বলছে—বিয়ানীবাজারের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই মানসম্মত শিক্ষাদানে পিছিয়ে পড়েছে।
আদর্শ মহিলা কলেজের ফলাফল বিশ্লেষণ
বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের ফলাফল এ বছর বিশেষভাবে হতাশাজনক। বিজনেস স্টাডিজ বিভাগে: কৃতকার্য ১৪ জন, অকৃতকার্য ১৩৫ জন।মানবিক বিভাগে: কৃতকার্য ৭৬ জন, অকৃতকার্য ১৯০ জন। বিজ্ঞান বিভাগে: কৃতকার্য ৫ জন, অকৃতকার্য ৭ জন। মোট ৪২৭ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৯৫ জন—যা পাশের হার মাত্র ২২.২৪ শতাংশ।
এই ফলাফল কলেজটির পাঠদান, শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি এবং প্রশাসনিক তদারকির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্থানীয় মহলে।
গোলাপগঞ্জের ফলাফল চিত্র
গোলাপগঞ্জ উপজেলার মোট ১৭টি কলেজ থেকে ২,৬৮৪ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১,৯৬০ জন, ফলে পাশের হার ৭৩.০১ শতাংশ। উপজেলায় ৪৩ জন শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ অর্জন করেছে।
সর্বোচ্চ ফলাফল করেছে সরকারি এম. সি. একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যেখানে পাশের হার ৮৯.৪৭ শতাংশ এবং ৩৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পেয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাণাপিং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, পাশের হার ৮৯.১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, ভাদেশ্বর কলেজে পাসের হার মাত্র ১৩ শতাংশ—যা উপজেলার সর্বনিম্ন। বিপরীতে ভাদেশ্বর মহিলা ডিগ্রি কলেজের পাসের হার ৮৫ শতাংশ, যা প্রশংসনীয়।
আরও উল্লেখযোগ্য কিছু প্রতিষ্ঠানের পাসের হার — ঢাকা দক্ষিণ সরকারি কলেজ: ৩০.১৩%, ঢাকা দক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ: ৮০.৭৮%, ঢাকা দক্ষিণ বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ: ৬০%, ডা. সৈয়দ মকবুল হোসেন কলেজ: ৬৯.৪৯%, আল-আমিন মহিলা কলেজ: ৪৪.৯০%, রণখেলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ: ৮২%। এ উপজেলায় ৭টি কলেজে পাসের হার ৫০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, জিপিএ–৫ প্রাপ্তির হারও গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
উভয় উপজেলার সামগ্রিক তুলনা
বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ—দুই উপজেলায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৫,০৬০ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩,৬৪৩ জন, ফলে গড় পাশের হার দাঁড়িয়েছে ৭১.৯৯ শতাংশ।
উভয় উপজেলায় মোট ৬৯ জন শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ অর্জন করেছে। তন্মধ্যে বিয়ানীবাজারে ২৬ জন, গোলাপগঞ্জে ৪৩ জন।
তুলনামূলকভাবে গোলাপগঞ্জের ফলাফল কিছুটা ভালো হলেও, উভয় উপজেলাতেই শিক্ষা মানে সার্বিক উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে বিয়ানীবাজারে ফলাফলের নিম্নগতি একটি গভীর শিক্ষা সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ফলাফল বিপর্যয়ের সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ
ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষক সংকট, পাঠদানের মানহীনতা, এবং একাডেমিক পরিবেশের দুর্বলতা এ বিপর্যয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। অনেক শিক্ষার্থী বছরের বড় অংশজুড়ে অনুপস্থিত ছিল, পরীক্ষার আগে তড়িঘড়ি করে প্রস্তুতি নেওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, কলেজগুলোতে ফল বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকাও মানোন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার ধারাবাহিকতা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে না পারাও একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
শিক্ষা মানের সংকটের প্রতিচ্ছবি
সিলেট বোর্ডের এইচএসসি ফলাফল ২০২৫ শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগত ব্যর্থতা নয়—এটি শিক্ষা মানের অবনতির এক বাস্তব চিত্র। গোলাপগঞ্জ উপজেলায় কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও বিয়ানীবাজারের ফলাফল শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
অতএব, যৌথ উদ্যোগ, প্রশাসনিক তদারকি ও শিক্ষক–শিক্ষার্থীর দায়বদ্ধতা—এই তিনটিই শিক্ষা বিপর্যয় থেকে উত্তরণের মূল চাবিকাঠি।
আশু পদক্ষেপের প্রয়োজন
শিক্ষাবিদদের মতে, এ অবস্থায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ফলাফল বিশ্লেষণ সভা আয়োজন, দুর্বল শিক্ষার্থীদের সহায়ক ক্লাস চালু, এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও একাডেমিক মনিটরিং জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যচর্চায় যুক্ত করা গেলে এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণ সম্ভব।
একই সঙ্গে উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষাপ্রশাসনের মাধ্যমে কলেজগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি, মডেল ক্লাস চালু, এবং ফলাফল উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গি : পুনরুত্থানের প্রত্যাশা
বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ—দুই উপজেলার শিক্ষা বাস্তবতা প্রায় অভিন্ন। সামগ্রিকভাবে এ দুই অঞ্চলে শিক্ষার মান রক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাঠপদ্ধতি চালু করাই হতে পারে পুনরুত্থানের পথ।
স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদরা আশাবাদী—সমন্বিত উদ্যোগ ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আগামী বছরেই এ বিপর্যয় কাটিয়ে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষায় নতুন আলোর সূচনা হবে।
একই সঙ্গে অভিভাবকদেরও সন্তানের শিক্ষা তদারকিতে আরও সক্রিয় হতে হবে। শিক্ষা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সমন্বিত মানোন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে, আগামী বছরের ফলাফল অনেক বেশি ইতিবাচক হবে—এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯