লেখক-Π আতাউর রহমান
শিক্ষক সমাজকে বলা হয় জাতি গড়ার কারিগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য—যারা সারাজীবন শিক্ষার্থীদের মনন ও চরিত্র গঠনে নিবেদিত থেকেছেন, সেই বেসরকারি শিক্ষকেরাই অবসরে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরের দিনই পেনশন ও গ্রাচুইটি পান, অথচ বেসরকারি শিক্ষকেরা প্রাপ্য কল্যাণ তহবিল ও অবসর সুবিধার অর্থ পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে শুধু তাদের জীবনের শেষ প্রহরগুলো কষ্টকর হয়ে উঠছে না, বরং জাতি গঠনের মহান দায়িত্বপালনকারীদের সম্মানও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
● কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার সূচনা
১৯৯০ সাল থেকে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট চালু হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সাল থেকে অবসর সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। নীলক্ষেতে ব্যানবেইস ভবনে গড়ে ওঠে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়।
এর উদ্দেশ্য ছিল—শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসরে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এ দুটি প্রতিষ্ঠানই তহবিল সংকট, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষক সমাজকে নিরাশ করছে।
● বাস্তবতা ও সংকট
১. ব্যাংক সংকট: কল্যাণ সুবিধা বোর্ডের সব টাকা ও লেনদেন হতো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়ে। এতে কল্যাণ বোর্ডের ৩০ কোটি টাকা ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করে ব্যাংকটি।
২. অবসর সুবিধার ঘাটতি: চলতি বছরের ২২ মে পর্যন্ত অবসর সুবিধা বোর্ডে ৪৫ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এগুলো নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ বোর্ডের মাসিক চাহিদা ৬৫ কোটি টাকা হলেও জমা হয় মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। প্রতি মাসে গড়ে ১০ কোটি টাকা ঘাটতি তৈরি হয়, যা বছরে দাঁড়ায় ১২০ কোটি টাকা।
৩. কল্যাণ সুবিধার ঘাটতি: কল্যাণ ট্রাস্টে এখনো প্রায় ৪২ হাজার ৬০০ আবেদন নিষ্পন্ন হয়নি। এগুলো নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন হবে ৩,৯৩০ কোটি টাকা।
৪. আবেদনকারীদের দুর্ভোগ: বর্তমানে প্রায় ৮৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী বছরের পর বছর ঘুরছেন নিজেদের জমানো টাকা ফেরত পেতে।
● টাকার উৎস কোথায়?
অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অর্থ মূলত শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করা হয়—
✦ অবসর সুবিধার জন্য চাকরিকালীন মূল বেতনের ৬% টাকা মাসে কেটে রাখা হয়।
✦ কল্যাণ সুবিধার জন্য মূল বেতনের ৪% টাকা মাসে কাটা হয়।
✦ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসর, ৩০ টাকা কল্যাণ) নেওয়া হয়।
✦ বাকিটা আসে সরকারি বরাদ্দ ও জমার সুদ থেকে।
অর্থাৎ শিক্ষকরা সারাজীবন বেতন থেকে কেটে জমা দিয়েছেন, শিক্ষার্থীরাও দিয়েছে, অথচ নিজেদের প্রাপ্য টাকা ফেরত পেতে শিক্ষকরা বছরের পর বছর ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।
● আদালতের নির্দেশনা বনাম বাস্তবতা
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ দেন—অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ছয় মাসের মধ্যে ভাতা পরিশোধ করতে হবে। আদালতের ভাষায়—“একজন শিক্ষককে অবসরভাতা পেতে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতে পারে না।”
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে—অর্থের অভাবে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ফলে সমস্যার সমাধান না হয়ে তা আরও জটিল হচ্ছে।
● শিক্ষকদের সম্মান রক্ষায় জরুরি করণীয়
১. প্রক্রিয়া সরলীকরণ ও ডিজিটাল ব্যবস্থা: আবেদন ও অর্থপ্রদানের সব ধাপ অনলাইনে করতে হবে।
২. সরকারি খাতের মতো সুবিধা: গ্রাচুইটি ও পেনশন চালু করে শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ: প্রতিবছর শিক্ষক কল্যাণ ও অবসর সুবিধার জন্য আলাদা তহবিল রাখা।
৪. ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সংস্কার: অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে নিরাপদ রাখা।
৫. অন্তর্বর্তী সমাধান: বর্তমানে চলমান প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে অন্তত ৫-৬ হাজার কোটি টাকা দ্রুত বরাদ্দ দেওয়া।
● ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বিশেষ প্রত্যাশা
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শিক্ষক সমাজ আশা করে—শিক্ষার মর্যাদা ও মানবিক কল্যাণের প্রশ্নে তিনি কার্যকর ও মানবিক পদক্ষেপ নেবেন। মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকার বরাদ্দে লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর দুঃখ দূর করা সম্ভব। এটি হবে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ।
● উপসংহার
শিক্ষক সম্মান হারালে শিক্ষা ও জাতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য ভাতা দ্রুত পরিশোধ শুধু অর্থনৈতিক দায় নয়, বরং একটি নৈতিক দায়িত্ব।
জাতি গড়ার কারিগরদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানাতে হলে কল্যাণ তহবিল ও অবসর সুবিধার জটিলতা দূর করতে হবে। রাষ্ট্র যদি এখনই হস্তক্ষেপ করে, তবে শিক্ষকদের মুখে ফিরবে প্রাপ্য সম্মান ও স্বস্তি—যা একটি উন্নত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯