✍️ পঞ্চখণ্ড আই ডেস্ক :
এক বছর পর আবার ফিরে এলো সেই দিন—৫ আগস্ট, যা আন্দোলনকারীদের ভাষায় ‘৩৬ জুলাই’ নামে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। ২০২৪ সালের এই দিনটি ছিল শ্রাবণের শেষ বিকেল, আর বিয়ানীবাজার পৌরশহরে ছিল মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার উল্লাস ও আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ।
সেদিন বিকালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় বিজয়ের মিছিলে। কেউ হাতে ধরেছিল লাল-সবুজের পতাকা, কারো চোখে ভেসে উঠছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, শহরের আবহাওয়া ততই রূপ নিয়েছে অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠায়।
বিকাল ৫টার কিছু পরই গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে বিয়ানীবাজার শহর। মুহূর্তেই বিজয়ের উৎসব রূপ নেয় মৃত্যুর বিভীষিকায়। রাজপথে লুটিয়ে পড়েন তিন তরুণ—তারেক আহমদ, ময়নুল ইসলাম ও রায়হান হোসেন। গুলিবিদ্ধ হন আরো অনেকে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুবাগের নাজমুল ইসলাম তাজিম চৌধুরী। শহরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে রক্ত। পড়ে থাকে ছেঁড়া ব্যানার, ছিটকে যাওয়া জুতা, ছিন্নভিন্ন পতাকা—সব মিলিয়ে এক নৃশংস, হৃদয়বিদারক দিন।
★ শহীদ পরিবারের কান্না থামেনি :
তারেক আহমদের মা ইনারুন নেসা আজো ছেলের মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেন না। তিনি বলেন,
“পিতার শোকে তার সন্তানরা কাঁদছে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান।”
ময়নুল ইসলামের স্ত্রী শিরিন বেগম বলেন,
“বিজয়ের আনন্দ নিয়ে গেল, আর ফিরেনি। সে আর কোনোদিন ফিরবে না। সরকার বদলাবে, কিন্তু আমার স্বামী আর ফিরে আসবে না।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, “হত্যার মামলায় কোনো অগ্রগতি নেই। অনেক আসামী প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।”
তৃতীয় শহীদ রায়হান হোসেন ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী, মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিদায় নেন। তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। তাঁর পরিবার তখন বিয়ানীবাজার পৌরসভার পূর্ব নয়া গ্রামে ভাড়া থাকতেন।
অন্যদিকে, ময়নুল ইসলামকে টিএন্ডটি রোডের পৌর কবরস্থানে এবং তারেক আহমদকে কটুখালিপাড়ের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিহতদের দাফন সম্পন্ন করা হয় ময়নাতদন্ত ছাড়াই।
আহত নাজমুল ইসলাম তাজিম চৌধুরী, যিনি মামলার অন্যতম বাদী, এখনও শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন বলে অভিযোগ রয়েছে।
★ চারটি মামলা, একাধিক প্রভাবশালী আসামী :
এই ঘটনায় বিয়ানীবাজার থানায় দায়ের হয় ৪টি মামলা—তিনটি হত্যা মামলা এবং একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। এজাহারে নাম রয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তির, যাঁদের মধ্যে আছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন খান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব সহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। এমনকি কয়েকজন সাংবাদিককেও আসামী করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, মামলার তদন্ত চলছে। অনেক আসামী এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
★ বিচারের দাবি ও প্রশাসনের অবস্থান :
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সিলেট জেলা সহ-সমন্বয়ক শাহরিয়ার আলম সানি বলেন,
“শহীদের রক্তের ওপর সরকার গঠিত, অথচ হত্যার বিচার আজও হয়নি। আমরা দ্রুত বিচার দাবি করছি।”
বিয়ানীবাজার থানার ওসি আশরাফ উজ্জামান জানান,
“জুলাই-আগস্টের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁদের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অনেক আসামীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।”
বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মুস্তাফা মুন্না বলেন,
“ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে থাকতে প্রশাসন সবসময় সচেষ্ট থেকেছে। আমরা তাদের সহায়তা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।”
★ ইতিহাসের দায় :
৫ আগস্ট ২০২৪—বিয়ানীবাজারের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত সন্ধ্যা। এ দিন শুধুই তিনটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং সুবিচারের দাবির এক জীবন্ত দলিল। শহীদেরা ফিরে আসবেন না, কিন্তু ইতিহাস তাঁদের নাম ভুলবে না—যদি আমরা সত্যকে খুঁজে বের করতে পারি, বিচার নিশ্চিত করতে পারি, এবং রাষ্ট্রীয় শুদ্ধতা রক্ষায় সোচ্চার থাকি।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯