Π বিশেষ নিবন্ধ
হাসিনা বিরোধিতা বনাম কাঠামোগত ফ্যাসিবাদ:
🖊️ Π আতাউর রহমান
🔷 প্রেক্ষাপট :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল একটি অনন্য ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই সময়ের পর থেকে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শিক গোষ্ঠী ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার নামে যেভাবে বক্তব্য দিতে শুরু করল, তা জনমনে আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ততই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে—এই বিরোধিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি নির্ভর, কাঠামোগত নয়। বিরোধী দলের বক্তব্যে ফ্যাসিবাদ শব্দের ব্যবহার বাড়লেও, রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রীকরণ, মত প্রকাশের নিয়ন্ত্রণ, আইনের অপপ্রয়োগ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি—এসবের বিরুদ্ধে তেমন কোনো সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
🔷 ব্যক্তি নয়, কাঠামোই মুখ্য :
শেখ হাসিনা কিংবা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা একটি সহজ রাজনৈতিক পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ কেবল একজন ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ, যা কেবল ব্যক্তি সরিয়ে দিলেই তা বিলুপ্ত হয় না; সরকার পরিবর্তন করলেই বদলায় না।
ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা ব্যক্তিনির্ভর নয়—বরং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, নীতির বিরুদ্ধে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। অথচ বর্তমানে বিরোধী দলগুলো কেবল নেতৃত্বের বিরোধিতা করে, কিন্তু কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য দৃশ্যমান কার্যক্রমে অনুপস্থিত।
🔷 বিবৃতি বনাম বাস্তবতা :
ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা কেবল বক্তব্য দিয়ে হয় না; তা পরিশ্রম, ত্যাগ, সংগঠন ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দাবি করে।
প্রশ্ন হচ্ছে—
➤আজ যারা “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার”-এর কথা বলেন, তারা কি জনগণকে সংগঠিত করেছেন?
➤তারা কি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী বয়ান তৈরি করতে পেরেছেন?
➤তারা কি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষাঙ্গনের স্বায়ত্তশাসন, বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সরাসরি লড়াইয়ে আছেন?
বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ দল ও জোট বিবৃতিমুখী। অনেকেই শাসকের ছায়াতলে থেকে 'নিয়ন্ত্রিত বিরোধী' হয়ে উঠেছেন। আর পদ-সুবিধা ও নির্বাচনী অংশগ্রহণেই অধিক আগ্রহী।
🔷 কাঠামোগত ফ্যাসিবাদ ও সুবিধাভোগের দ্বৈততা:
ফ্যাসিবাদ কেবল দমন নয়, নিয়ন্ত্রিত অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রিত বিরোধিতার সুযোগও তৈরি করে। এ সুযোগ অনেক বিরোধী দল নানা পর্যায়ে গ্রহণ করছে:
• রাষ্ট্রীয় অনুদান, মনোনয়ন বা অনুমোদনমূলক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
• নির্বাচনে প্রার্থিতা দিয়ে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর অংশীদার হওয়া
• স্বাধীন মত প্রকাশে সেন্সর ও হয়রানির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়া
ফলে প্রশ্ন উঠে—এ গুলো সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য, নাকি কেবল ব্যক্তিগত বা দলীয় লাভের জন্য? এতে
এসব দল নিজেরাও নাগরিক প্রতিরোধের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। একদিকে গণতন্ত্রের কথা, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর অংশীদারিত্ব—এ যেন আত্মবিরোধিতার রাজনীতি।
🔷 যদি সত্যিকারের ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা হতো:
যদি এই বিরোধিতাগুলো সত্যিকার কাঠামোগত হতো, তাহলে আমরা দেখতে পেতাম—
➤ যুগপৎ রাজপথ আন্দোলন এবং সাংগঠনিক পুনর্গঠন
➤ নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সংযুক্তি
➤ তথ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে ভিত্তি করে বিকল্প বয়ান তৈরি
➤ চিন্তার সাহস ও আদর্শিক পরিশুদ্ধি
এই চারটি ক্ষেত্রেই বিরোধী রাজনৈতিক বলয়ে বড় ধরনের শূন্যতা বিদ্যমান। ফলে এগুলোর বিরোধিতা কেবল মুখে, কাজের জায়গায় নেই।
🔻 উপসংহার :
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা আসলে এক আত্মবিরোধিতার চিত্র। যেখানে ব্যক্তি-বিরোধিতা প্রবল, কিন্তু কাঠামো-বিরোধিতা অনুপস্থিত। যেখানে ‘বিরোধী’ বলয়ে অনেকেই সেই কাঠামো থেকেই সুবিধা নিচ্ছেন, আবার মুখে তার বিরোধিতা করছেন।
ফলে প্রশ্নটা আর শুধু ক্ষমতার পালাবদলের নয়—এটা রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা, নৈতিকতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন।
ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা যদি সত্যিই করতে হয়—তবে তা নেতৃত্বের বদল নয়, গঠনমূলক কাঠামোর রূপান্তরের মধ্য দিয়েই সম্ভব। এটাই সময়ের দাবি, আর জনগণেরও প্রত্যাশা।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯