Π ফয়জুল চৌধুরী বাবুল
বীজ থেকে চারা, চারা থেকে বৃক্ষ, বৃক্ষ যখন ফুলে-ফলে পরিণত হয়— তখন বীজ বপনকারীর চেয়ে বেশি আনন্দিত আর কে হতে পারে?
একটি স্বপ্ন বাস্তব হয়ে উঠলে সেই স্বপ্নদ্রষ্টার হৃদয় হয় সবচেয়ে প্রশান্ত।
আজ আমি এমন এক স্বপ্নের বাস্তব রূপ লাভের কাহিনী আমার প্রিয় ফেসবুক বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
● শুরুটা ছিল একজন বৃদ্ধ মায়ের কারণেই...
আমরা সবাই সিলেট শহরে থাকি। আমার ব্যবসা, ভাইয়ের চাকরি, বোনদের সংসার—সবই শহরমুখী। এ পরিস্থিতিতে আমাদের বৃদ্ধ মা-কে কি আর গ্রামের বাড়িতে রাখা যায়। তাই কেয়ারটেকারের হাতে বাড়ি রেখে আমরা শহরে বাস করতাম। কিন্তু শহরে থাকলেও মনের টান ছিল গ্রামের বাড়ির প্রতি। তাই মাসে দু’একবার বাড়ি যেতাম, আর নিজের লাগানো গাছপালা, বাগান আর ঘরের অবস্থার খোঁজও নিতাম।
একবার শহরে ফেরার পথে গ্রামের নাগেশ্বর গাছতলায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ বিয়ানীবাজার থেকে আসা একটি টেম্পু থামল। কয়েকজন ছাত্রী নামল। কথা বলে জানলাম তারা বিয়ানীবাজার কলেজে পড়ে। তাদের বাড়ি মোল্লাপুর, পাতন।
তাদের কথায় বুঝতে পারলাম, দক্ষিণ বিয়ানীবাজার, বড়লেখা উত্তর ও কানলি এলাকাসহ বৃহত্তর অঞ্চলে কলেজগামী মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। ভাবলাম—এতগুলো হাইস্কুল পেরিয়ে প্রতিবছর এত মেয়ে এসএসসি পাস করে, অথচ কাছে কোনো মহিলা কলেজ নেই! তাহলে এ এলাকায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব নয়?
● প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন: ভাবনা ও সামাজিক উদ্যোগ
সারা রাত ভাবনায় কাটল—গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন মনে জেগেছে, তা বাস্তবায়নের জন্য কাদের সাথে আলাপ করা যায়? আমার পক্ষে ব্যবসা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে সবাইকে সংগঠিত করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই প্রয়োজন এলাকার স্থায়ী, শিক্ষিত ও সমাজসেবী ব্যক্তিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ল আমার শিক্ষক ও বড় ভাইয়ের বন্ধু, কালাইউরা গ্রামের অধিবাসী এবং বিয়ানীবাজার কলেজের অধ্যাপক জনাব রফিক আহমদ এবং আমার আত্মীয়, সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী জনাব আব্দুল বাতিন তাপাদার—এই দুইজনই হতে পারেন সম্ভাব্য উদ্যোগের মূল চালিকাশক্তি।
রফিক স্যার প্রায়ই সিলেট আসেন এবং আমার বন্ধু কানিজ ট্রাভেলস-এর স্বত্বাধিকারী আব্দুল আহাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করেন। আমি আহাদ ভাইকে অনুরোধ করলাম, রফিক স্যার সিলেট এলে যেন আমাকে জানান। ঠিক সেদিনই রফিক স্যার সিলেট আসেন, ফোনে আমাকে জানিয়ে কিছু সময় পর আমার অফিসে (হক এজেন্সি, মিতালী ম্যানশন) চলে আসেন। আমি তাঁকে আমার কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলেন, “চমৎকার একটি উদ্যোগ—আমাদের মাথায়ই আসেনি। অবশ্যই কাজটা শুরু করা উচিত।”
আহাদ ভাইও উৎসাহ দিয়ে বললেন, “সিলেট থেকে সভা হলে ছাদ চাচা, লোকমান ভাইসহ আমরা সবাই উপস্থিত হব।”
পরদিন আমার অফিসের নিচে ‘ঘরনী’ নামক দোকানে দেখা হয়ে যায় জনাব বাতিন তাপাদার সাহেবের সাথে। আমি তাঁকে অফিসে ডেকে বিষয়টি বিস্তারিত জানাই এবং অনুরোধ করি, তিনি যেন রফিক স্যারের সঙ্গে মিলে একটি সভা আহ্বানের ব্যবস্থা করেন। জমির বিষয়টি উত্থাপন করলে আমি বললাম, লোকজন একমত হলে জমি হয়তো কেউ দান করতেও পারেন। প্রয়োজনে সবাই মিলে জমিও কেনা যাবে। আমি ওয়াহিদুর রহমান সাহেবের কথাও উল্লেখ করলাম, যদিও পরে জানতে পারি, জলঢুপ এলাকায় তাঁর জমি নেই।
বাতিন সাহেব বললেন, “আমি উদ্যোগ নেব। তবে আপনি এখন আর কাউকে কিছু বলবেন না। বচন হাজী সাহেব অনেক টাকা এনেছেন—শুনলে হয়তো তিনিই এগিয়ে যাবেন।”
এদিকে আমি বসে থাকিনি। ভাদেশ্বর মহিলা কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। কলেজ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আমার শ্বশুর নূরুল ইসলাম চৌধুরী (ময়না মিয়া)। সুযোগে শিক্ষা সচিব হেদায়েত আহমদের সাথে দেখা হলে তিনি বলেন, “বোর্ডের অ্যাফিলিয়েশন ছাড়া মন্ত্রণালয়ের সহায়তা পাওয়া যাবে না।”
পরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও কুমিল্লা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল আজিজ স্যারের সাথেও কথা বলি। তিনি বলেন, “চিঠি দিলে বোর্ড অবশ্যই সম্মান করবে, শিরুকে তো আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, তারাই অ্যাফিলিয়েশন পেয়েছে।”
এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়—খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসে।
বাতিন সাহেবের সাথে আবার দেখা হলে তাঁকে বাসায় এনে বিস্তারিত জানাই। জমির বিষয়টি নিয়েও আমরা আলোচনা করি। আমি চাচা তমচ্ছিন আলী চৌধুরী ও তবারক আলী চৌধুরীর জায়গার কথা বলি। যদিও উনারা আমাকে পছন্দ করেন না, কিন্তু কলেজের জন্য জমি চাওয়া গেলে হয়তো বিবেচনা করতেন। জায়গাটি একটু ভেতরে, তবে রাস্তাসহ সহজে কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস হতে পারে।
এরই মধ্যে কয়েকটি সভা হয়ে গেল, যার কোনো খবরই আমি পাইনি। পরে রফিক স্যার অফিসে এসে জানালেন যে তিনি আমাকে সভার বিষয়ে বলেননি, ভেবে নিয়েছেন আমাকে বলা হয়েছে। আমি অভিযোগ করলে বাতিন সাহেব বলেন, তিনি ছাদ চাচার মাধ্যমে জানাতে বলেছেন। কিন্তু ছাদ চাচা তা অস্বীকার করেন।
অবশেষে, আমার চাচা তমচ্ছিন আলী চৌধুরী ও তবারক আলী চৌধুরী কলেজের জন্য জমি দান করতে সম্মত হন। বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আকমল আলী (অবঃ প্রধান শিক্ষক) ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করলে আহ্বায়ক হন আমার আরেক চাচা তজম্মুল আলী চৌধুরী।
প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়, অস্থায়ী কার্যক্রম আমার বাড়িতে শুরু হবে। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় পরে তা জলঢুপ হাই স্কুলে স্থানান্তর করা হয়।
● নামকরণ, নীতি নির্ধারণ ও শুভসূচনা:
কলেজের নাম রাখা হলো "বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজ", অবৈতনিক প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জনাব সুলতান কবির (চুনু)। এরপর এলাকার মানুষ, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন সবাই যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসেন। একজনের স্বপ্ন এক সময় বহুজনের প্রচেষ্টায় বাস্তব রূপ নেয়।
এদিকে পূর্ণোদ্যমে কলেজ উন্নয়নের কাজ এগিয়ে চলছে। এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজন যার যা সামর্থ্য, তা নিয়েই এই মহতী উদ্যোগে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কেউ শ্রমে, কেউ অর্থে, কেউ পরামর্শে—এই সম্মিলিত প্রয়াসে কলেজের ভিত্তি দৃঢ় হচ্ছে।
● সম্মানিত অতিথিদের কলেজ পরিদর্শন:
অধ্যাপক আব্দুল আজিজ স্যার প্রায়ই কলেজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। একদিন আমি তাঁকে কলেজ পরিদর্শনের জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানাই। তিনি আনন্দের সাথে সম্মতি দেন। ঠিক সেই সময় ‘বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদ’-এর একটি সভা মৌলভীবাজার পৌরসভায় অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই—যেহেতু সভাটি সন্ধ্যায়, তাই সকালেই রওনা দিয়ে বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, কুলাউড়া হয়ে মৌলভীবাজারে পৌঁছাবো, এবং পথিমধ্যে কলেজ পরিদর্শনের কাজটি সেরে নেব।
আব্দুল আহাদ ভাই নিজস্ব যানবাহন ব্যবহারের অনুমতি দেন। রফিক আহমদ স্যার মেহমানদের জন্য সৌজন্যমূলক মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমি কলেজ সংশ্লিষ্ট সকলকে মেহমানদের স্বাগত জানাতে পূর্বেই অনুরোধ জানাই।
প্রায় ১১টা-১২টার দিকে আমাদের গাড়ি কলেজ টিলার পাদদেশে পৌঁছায়। সেসময় সেখানে মাটি কাটার কাজ চলছিল, আর ক্লাস নেওয়া হচ্ছিল জলঢুপ হাই স্কুলে। আমরা সেখানেই মেহমানদের নিয়ে যাই।
সেদিনের মেহমানদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন—
সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, অধ্যাপক আব্দুল আজিজ, অধ্যাপক আবুল বাশার, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ প্রমুখ।
তাঁরা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং কলেজের পরিদর্শন খাতায় মূল্যবান মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন।
স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন— জনাব তজম্মুল আলী চৌধুরী (আহ্বায়ক, কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি), জনাব আব্দুল বাতিন তাপাদার, অধ্যাপক রফিক আহমদ, অধ্যক্ষ সুলতান কবির, আব্দুল জলিল (চেয়ারম্যান, লাউতা ইউনিয়ন), মোস্তাকিম আলী (চেয়ারম্যান, মোল্লাপুর ইউনিয়ন),ববিশিষ্ট ব্যবসায়ী জামিল আহমদ (কোনাগ্রাম) প্রমুখ।
কলেজ পরিদর্শন শেষে আমরা অধ্যাপক রফিক আহমদ স্যারের কালাইউরাস্থ বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিই। এরপর আমরা মৌলভীবাজার পৌরসভায় সভায় যোগ দিতে রওনা দিই—একটি সফল দিনকে পেছনে রেখে, আরও সাফল্যের প্রত্যাশায়।
এই অগ্রযাত্রায় বিশেষভাবে স্মরণ করি অধ্যাপক আব্দুল আজিজ স্যারকে—তাঁর উৎসাহ, এ্যাফিলিয়েশন সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা এবং কলেজ পরিদর্শন আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছিল। মোল্লাপুর প্রাইমারি স্কুলে অনুষ্ঠিত সভা, রফিক স্যারের আহ্বানে কার্যক্রম, পরিদর্শনকালীন ভোজন আয়োজন—সবই যেন আজো চোখে ভাসে।
● একটি সফল যাত্রার গল্প:
আজ কলেজটি সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষকদের আন্তরিকতায় ফলাফল ভালো হচ্ছে, মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে জ্ঞানে ও মননে। অনেকেই এই প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন, কিন্তু আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁদের জন্য দোয়া করি—আল্লাহ তাঁদের জান্নাত দান করুন। আর যারা এখনো আছেন, তাঁদের জন্য দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করি।
একটি স্বপ্ন বাস্তব হলো মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আমি গর্বিত, সেই স্বপ্নের বীজবপনকারী হতে পেরে।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯