আতাউর রহমান :
বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যে আর্থিক অনিয়ম, দুর্ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতার অভাব পরিলক্ষিত হয়, তা বহুদিনের আলোচিত বিষয়। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) উদ্যোগে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ই-ক্যাশবুক চালুর চিন্তাটি একটি সময়োপযোগী ও নীতিগতভাবে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে এর বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ, অংশীজনদের অংশগ্রহণ এবং প্রান্তিক প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়ার ওপর। এই লেখায় ই-ক্যাশবুক চালুর প্রেক্ষাপট, ইতিবাচক দিক, সম্ভাবনা ও মাঠপর্যায়ের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সামগ্রিক গতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে নতুন নতুন উদ্যোগ সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়। তবে যেকোনো পরিবর্তন বা নতুন ধারণা কতটা বাস্তবমুখী এবং কার্যকর হবে, তা নির্ভর করে ধারণাটি কোথা থেকে এসেছে তার ওপর। এ প্রেক্ষিতে বলা হয়, "Bottom-up approach" অর্থাৎ মাঠ পর্যায় থেকে উপরের দিকে যে ধারণা আসে, সেটি সাধারণত বেশি টেকসই ও বাস্তবঘনিষ্ঠ হয়। আর ‘"Top-up approach"’ অনেক সময় চাপিয়ে দেওয়া মনে হয়, ফলে বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে শিক্ষা প্রশাসনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই হয় ‘টপ-ডাউন’ ধাঁচে।
গত ১৭ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ই-ক্যাশবুক’ চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি সেমিনার আয়োজন করে। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে আয়োজিত এই সেমিনারে ১৫টি কলেজের ৪৫ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা শহরের বেশকিছু প্রভাবশালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব বদরুন নাহার। ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন। আলোচনা পর্বে শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় আর্থিক অনিয়ম, স্বচ্ছতার অভাব, জবাবদিহিতার সংকট দেখা যায়। বিশেষ করে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মাসিক বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা আসার পরও অনেক ক্ষেত্রে হিসেব-নিকেশে স্বচ্ছতা বজায় থাকে না। অনেক পরিচালনা কমিটি শিক্ষাকে গৌণ করে অর্থনীতিকে মুখ্য করে তোলে, ফলে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
এই প্রেক্ষাপটে ই-ক্যাশবুক একটি কার্যকর প্রযুক্তি-নির্ভর পদক্ষেপ হতে পারে, যা কেবল আর্থিক স্বচ্ছতা নয়, বরং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। অনেকে বলছেন, এই ব্যবস্থায় কাগজের হিসাবরক্ষণ কমে যাবে, স্টেশনারি ও পরিবহন খরচ হ্রাস পাবে, লেনদেনের স্বচ্ছতা বাড়বে, এমনকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল শিক্ষার আগ্রহও বাড়তে পারে।
তবে এই আশাবাদের মাঝেও বাস্তবতা ভিন্ন। সেমিনারে অংশ নেওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই রাজধানী ও শহরকেন্দ্রিক, তুলনামূলকভাবে ধনী ও সংগঠিত। কিন্তু দেশের প্রায় ৩৫ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বিরাট অংশ রয়েছে যাদের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক। অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে শিক্ষার্থীদের স্বল্প বেতন, অনুদান বা দানের ওপর। এই বাস্তবতায় ই-ক্যাশবুক চালু করা তাদের জন্য একটি অতিরিক্ত চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অধিকাংশ গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা, উপকরণ, ইন্টারনেট সংযোগ কিংবা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে — এই প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগটি কাদের জন্য উপযোগী? শুধু বড় শহরের আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো কি এর মূল লক্ষ্য?
তবে এটাও সত্য, রাষ্ট্রীয় অর্থ যেখানে ব্যয় হচ্ছে সেখানে জবাবদিহিতা ও পর্যবেক্ষণ জরুরি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির পথ প্রশস্ত করেছিল — যা বাংলাদেশের শিক্ষা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেই ধারাবাহিকতায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ই-ক্যাশবুক একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
তবে এটিও নিশ্চিত করতে হবে — এই উদ্যোগ যেন বাস্তবতাবিবর্জিত, চাপিয়ে দেওয়া বা নির্বাচিত কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং সার্বিক পরিকল্পনার আওতায় মাঠপর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান, শিক্ষক, হিসাবরক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য একটি রূপরেখা তৈরি করা হোক। প্রয়োজনে পরীক্ষামূলক (pilot) ভিত্তিতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চালু করে তার ফলাফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ই-ক্যাশবুক একটি ইতিবাচক ধারণা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে গ্রহণযোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও কাঠামোগত সমন্বয়ের ওপর। টপ-ডাউন পদ্ধতিতে চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং শিক্ষক, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও বাস্তব ম্যানেজমেন্ট কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করে বটম-আপ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়াই হবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। আর্থিক স্বচ্ছতা যেমন জরুরি, তেমনি বাস্তব প্রয়োগযোগ্যতা, স্থায়িত্ব ও গ্রহণযোগ্যতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, শুধু শহুরে বড় প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা নয়, গ্রাম ও প্রান্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতাকেও বিবেচনায় এনে প্রযুক্তি নির্ভর স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তাহলেই ই-ক্যাশবুক হবে শুধু একটি 'উদ্যোগ' নয়, বরং শিক্ষা প্রশাসনে নৈতিকতা ও স্বচ্ছতার টেকসই মানদণ্ড।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও সমাজচিন্তক।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯