বাংলাদেশের জনমানসে রাজনীতি যেন একটি স্থায়ী উত্তেজনার নাম। রাজনীতির উপর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাক বা না থাক—তর্কের টেবিলে সবাই বিশেষজ্ঞ! চায়ের দোকানে, বাসের জানালায়, ফেসবুকের কমেন্টবক্সে—সবখানে একেকজন যেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।কিন্তু এই উচ্চকণ্ঠ তর্কের শব্দের ভিতরেই লুকিয়ে থাকে এক গভীর অজ্ঞতা—যেখানে বাস্তবতা নয়, চলে আবেগ, চলে গুজব, চলে পক্ষ-বিপক্ষের অন্ধ অনুসরণ।
এই জনগোষ্ঠী "গণতন্ত্র" বলতে বোঝে নির্বাচনের মাঠ, "ভোট" বোঝে পাঁচ বছরের এক দিনের অংশগ্রহণ,
ভোট মানে একদিনের দায়িত্ব, আর বাকি ১,৮২৪ দিন নোট আর রুটির চিন্তা। তারা গণতন্ত্রের চেতনায় নয়, নির্বাচনী জোটে বিশ্বাস করে। তারা রাষ্ট্রচিন্তার স্তরে নয়, বরং দলভিত্তিক লাভ-ক্ষতির গণ্ডিতে বন্দি। প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই মানসিকতা কি সত্যিই দেশপ্রেমের প্রতিচ্ছবি?
প্রকৃত দেশপ্রেম মানে নিজের অধিকারের পাশাপাশি নিজের কর্তব্য ও দায়বদ্ধতাকে হৃদয়ে ধারণ করা। আমরা 'অধিকার' চাই—কিন্তু তার বিনিময়ে যে 'নির্ভরতাবোধ', যে সচেতনতা, যে জবাবদিহিতা নাগরিক জীবনের শর্ত—তা অনুপস্থিত। আমরা চাই রাষ্ট্র আমাদের জন্য সব কিছু করবে, কিন্তু নিজেকে সেই রাষ্ট্রের গঠনমূলক অংশ হিসেবে ভাবতে অনিচ্ছুক।
একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি সমাজে গভীরভাবে গেঁথে গেছে—দেশের ভূখণ্ড রক্ষা শুধু সেনাবাহিনীর দায়িত্ব, এই ধারণা বাস্তবতার অপমান। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেনাবাহিনী বন্দুক দিয়ে সীমান্ত পাহারা দেয়, কিন্তু নাগরিক সমাজ তার চেতনা দিয়ে দেশকে রক্ষা করে। সচেতনতা, সততা, তথ্যনির্ভরতা, ও নৈতিক অবস্থান—এই চারটি শক্তিই একজন নাগরিককে আত্মরক্ষার দুর্ভেদ্য প্রাচীরে পরিণত করে।
সিটিজেনশিপ মানে শুধুই নাগরিক আইডি কার্ড নয়। এটি এক গভীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক সম্পর্ক। এর ভেতরে রয়েছে—আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, ন্যায়বোধ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্য জানার অধিকার। কিন্তু এইসবের সঙ্গে যুক্ত থাকে—ভুল তথ্যকে প্রতিরোধ করা, দায়িত্বপূর্ণ ভোট প্রদান, দল নয়—নীতি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, এবং প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতেও সাহসী হওয়া।
আজ যখন রাষ্ট্রের নানা সংকটে আমাদের মুখ থমথমে, তখন নিজের চেহারা আয়নায় দেখার সময়। আজ প্রশ্ন তোলা জরুরি—আমি একজন নাগরিক হিসেবে কতটা দায়িত্বশীল? আমি কি শুধু ভাতা আর সেবা চাই, নাকি ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াতেও প্রস্তুত?
আমাদের দরকার এক নতুন নাগরিক চেতনা—যেখানে অধিকার আর কর্তব্য একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক। যেখানে দেশপ্রেম মানে শুধু পতাকা ও গান নয়, বরং প্রতিবাদের কণ্ঠ, অংশগ্রহণের হাত, এবং চিন্তার দীপ্তি।
আমাদের তর্কের ধরন বদলাতে হবে। জানতে হবে, বুঝতে হবে, তারপর বলতে হবে। কারণ শুধু চিৎকার করে কেউ সিটিজেন হয় না, দায়িত্বে বিশ্বাসী হলেই একজন প্রকৃত নাগরিক জন্ম নেয়।
শেষ কথায় : রাষ্ট্র গড়ে কাগজে কলমে, কিন্তু টিকে থাকে নাগরিক চেতনায়। আর সেই চেতনা জাগে যখন অধিকার চাওয়া আর দায়িত্ব নেওয়ার মাঝে ভারসাম্য থাকে। সেখানেই গড়ে উঠে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ।
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আতাউর রহমান
আইন-উপদেষ্টা: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
বানিজ্যিক কার্যালয়: সমবায় মার্কেট, কলেজ রোড,
বিয়ানীবাজার পৌরসভা, সিলেট থেকে প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত।
ই-মেইল: 𝐩𝐚𝐧𝐜𝐡𝐚𝐤𝐡𝐚𝐧𝐝𝐚𝐞𝐲𝐞@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦 মোবাইল নম্বর: ০১৭৯২৫৯৮১২৯