আজ সোমবার (১৫ জানুয়ারি) প্রতি বছরের ন্যায় অনুষ্ঠিত হলো উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.) ১৬তম ঈসালে সওয়াব মাহফিল।
সিলেটের জকিগঞ্জে ফুলতলী ছাহেববাড়ি সংলগ্ন বালাই হাওরে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী (র.) এর ১৬ তম ঈসালে সওয়াব মাহফিলে লাখো ভক্ত আশিকানদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে জকিগঞ্জের বালাই হাওর। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুলতলী অভিমুখী জনতার স্রোত ছিল চোখে পড়ার মতো। আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর মাযার, মাহফিলের প্যান্ডেল, বাজার, রাস্তা-ঘাট সবই লোকে লোকারণ্য। সকাল সাড়ে ১০টায় এতীমখানার হাজারো এতীমসহ আগত মেহমানদের নিয়ে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেবের (র.) মাযার যিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মাহফিলের কার্যক্রম। এরপর খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, খতমে খাজেগান, খতমে দালাইলুল খাইরাতের পাশাপাশি স্মৃতিচারণমূলক ও জীবনঘনিষ্ঠ আলোচনায় অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে অতিবাহিত হয় পুরো দিন।
মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী ও মাওলানা নজমুল হুদা খানের পরিচালনায় মাহফিলে মুরিদীন-মুহিব্বীনের উদ্দেশ্যে তা’লীম-তরবিয়ত প্রদানকালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)’র উত্তরসূরি উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, মুরশিদে বরহক হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী বলেন, আল্লামা ফুলতলী (র.) বহু হৃদয়ে অসহায় মানুষের সেবার আগুন জ্বালিয়ে গেছেন। আমরা যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী, হানাফী মাজহাবকে অনুশীলন করি প্রত্যেকে আমরা যেন একে অপরের প্রতি ছোটখাটো বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি না করি। হযরত শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.), শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) প্রমুখ এ উপমহাদেশে আহলে সুন্নাতের অনুসরণীয় আলিম। এগুলো পড়লে অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। তাসাওউফের নামে এ উপমহাদেশে অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। শাহ ওলীউল্লাহ (র.) সঠিক পথ বাতলে দিয়েছেন। তার মাধ্যমে আমাদের সনদ রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
খতমে খাযেগান ও দু’আ শেষে মুরিদীন-মুহিব্বীনের উদ্দেশ্যে তা’লীম-তরবিয়ত ও হৃদয়গ্রাহী বয়ান পেশ করেন উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব, ফুলতলী আরও বলেন, আমরা ইয়া রাসূলুল্লাহ বলি, ইস্তিগাছায় বিশ্বাস করি। এ কারণে কেউ কেউ আমাদের বিদআতী বলে থাকেন। অথচ হযরত শাহ ওলীউল্লাহ (র.) এর কিতাবে ইস্তিগাছা রয়েছে। হযরত থানভী (র.) তার কিতাবে আরবী শে’র এনেছেন এবং এগুলোর উর্দু তরজমা করেছেন যেখানে ইস্তিগাছা রয়েছে। তাবলীগী নেসাবের কিতাব ফাযাইলে দরুদ এর মধ্যে যাকারিয়া (র.) আল্লামা জামী (র.) এর শে’র এনেছেন যেখানে ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে আহ্বান রয়েছে। সুতরাং আমরা যেন পরষ্পর ভুল বুঝাবুঝি থেকে বিরত থাকি।
তিনি আল্লামা ফুলতলী (র.) এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, কৈশোরের অনেক স্মৃতি আছে। মা-বাবা উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রাণপ্রিয় জন্মভূমির পথঘাট, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে যেন অসহায় মানুষের খেদমত করি। তার প্রেরণায় অসহায় মানুষের মৃত্যুর পর তাদের এতীম সন্তানদের কাছে যাই। অনেক ঝুপড়ি ঘরে প্রবেশ করি। সুরমার তীরে ভাঙা ঝুপড়ি ঘরে মাটির উপর চাটাইয়ে বসে যে তৃপ্তি পাই অট্টালিকায় বসে তা পাই না। অনেক দেশে গেছি কিন্তু গ্রামবাংলার অসহায় মানুষের পরশে যে প্রশান্তি পেয়েছি তা অতুলনীয়। অসহায় মানুষের সেবার এ আগুন আল্লামা ফুলতলী (র.) বহু হৃদয়ে জ্বালিয়ে গেছেন। এ খেদমত যেন কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকে। আমাদের খেদমতের অনেক প্রজেক্ট রয়েছে যার সবকিছু বলছি না। তবে কেউ মারা গেলে আমার কার্যালয়ের দায়িত্বশীলদেরকে খবর দেবেন।
সভাপতির বক্তব্যে হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব, ফুলতলী আরও বলেন, একমাত্র আল্লাহর মুখাপেক্ষী ছাড়া দুনিয়ার কারো মুখাপেক্ষী হওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) রোজগারের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.) দরিদ্র মানুষকে রোজগারের উপকরণ প্রদান করতেন। তার এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। আপনারাও মানুষদের মাঝে রোজগারের উপকরণ বিতরণ করবেন। মানুষের মাঝে রোজগারের সম্বল বিতরণ করা নবীজির সুন্নত। বৃক্ষরোপণ একটি উত্তম কর্ম। বৃক্ষ আমাদের নানা উপকারে আসে। মানুষ, পশু-পাখীসহ সমস্ত মাখলুক এর উপকার ভোগ করে। তাই সকলকে বৃক্ষরোপনে এগিয়ে আসতে হবে। একটি কদুর বীজও যদি হয় তা রোপণ করবেন। এ থেকেও অনেক নিয়ামত পাওয়া যাবে।
তিনি আরো বলেন, আমি আমার মা-বাবার নির্দেশে মাঝে মাঝে জন্মভূমির বিভিন্ন নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করি। দুঃখী মানুষের কাছে যাই, তাদের সাথে মিশি, এতিমদের কথা শুনি, তাদের আবদার পূরণে নিজেকে বিলিয়ে দেবার চেষ্টা করি। কারণ এতিমদের সালাত ও সালাম পাক মদীনায় প্রতিধ্বনিত হয়। আপনারাও এতিমদের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। অন্ধ, আতুর ও বিধবাদের সহযোগিতা করবেন, মিসকিনদের খাবার দেবেন। এতে জান্নাতের পথ সুগম হবে।
তিনি জনপ্রতিনিধিদের উদ্যেশ্যে বলেন, সম্প্রতি যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন বা হন নাই আপনার উভয়ে জনপ্রতিনিধি। কারণ উভয়েরই জনসমর্থন আছে। উভয়ে একে অন্যের সহযোগী হয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে জনখেদমতে নিয়োজিত হবেন। সরকারি অর্থ খাত ওয়ারী খরচ করবেন, গভীর রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণসহ অসহায়ের পাশে দাঁড়াবেন। মাটির আসনে বসার চেষ্টা করবেন, আর এটাই নবীজির শিক্ষা। কেউ খারাপ আচরণ করলে তার সাথে ভালো আচরণ করবেন, দু’আ করবেন আল্লাহ আমার দাম্ভিক মস্তককে অবনত করে দাও। সেটাই হবে কল্যাণের পথ।
পীর-মুরীদি সম্পর্কে তিনি বলেন, পীর-মুরীদির নামে যারা বিদ‘আতে লিপ্ত তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার ওয়ালিদ মুহতারাম সাধাসিধে আসনে বসতেন, তাঁর কোনো গদি ছিল না। তিনি মানুষদেরকে বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সত্য-সঠিক সিলসিলায় আশ্রয় গ্রহণ করার আহবান জানাতেন। তাঁর ভাষায় গভীর রাতে নির্জনে রাব্বে কারীমের জন্য দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে দিন, অন্তরের কালিমা দূরীভুত হয়ে যাবে। আমরা এক আল্লাহর কালিমা পড়েছি। আমরা নবীজির পথ অনুসরণ করি। তাই সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।
বাদ মাগরিব বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল্লামা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, সিলেট-৫ আসনের নবনির্বাচিত এমপি বক্তব্য প্রদান করেন। মাহফিলে বিশেষ অতিথি ছিলেন- ভারতের উজানডিহির পীর ছাহেব হযরত মাওলানা সায়্যিদ মোস্তাক আহমদ আল মাদানী, সায়্যিদ জুনাইদ আহমদ আল মাদানী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আলহাজ শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হযরত আল্লামা নজমুদ্দীন চৌধুরী, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, মহাখালী গাউসুল আযম মসজিদের খতীব মাওলানা কবি রুহুল আমীন খান, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছীনের মহাসচিব মাওলানা শাব্বির আহমদ মোমতাজী, ঢাকা দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আ. খ. ম আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।
মাহফিলে আরো বক্তব্য রাখেন- মাওলানা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, মুফতি মাওলানা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কমরুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, বাংলাদেশ আঞ্জুুমানে আল ইসলাহ’র মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা একেএম মনোওর আলী, ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হাফিয মাওলানা ফখরুদ্দীন চৌধুরী, জালালপুর জালালিয়া কামিল মাদ্রাসার আমেরিকা প্রবাসী বিশিষ্ট আলিমে দ্বীন মাওলানা আবূ আব্দিল্লাহ মো. আইনুল হুদা, মুহাম্মদপুর গাউছিয়া মাদ্রাসা ঢাকার প্রিন্সিপাল মাওলানা ইজহারুল হক, জকিগঞ্জ সিনিয়র মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মোশাহিদ আহমদ কামালী, মহাখালী কামিল মাদ্রাসা মুহাদ্দিস মাওলানা মাহবুবুর রহমান, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মুহিবুর রহমান, রাখালগঞ্জ সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা শেহাব উদ্দিন আলীপুরী, দারুল হাদীস লাতিফিয়া নর্থওয়েস্ট এর প্রিন্সিপাল মাওলানা সালমান আহমদ চৌধুরী, মাওলানা আজিজুর রহমান ধনপুরী প্রমুখ।