দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেটের ৬টি আসনের অন্যতম আসন সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ)। আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে গত দু’দিন ধরে একটা গুঞ্জন ছিল তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী শমসের মবিন চৌধুরী’র পাশে দাঁড়াতে পারে আওয়ামী লীগ। আদৌ এ গুঞ্জন সত্য নয়। তবে গোলাপগঞ্জ আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা প্রকাশ্যে শমসের মবিনের পক্ষে সোনালী আঁশ প্রতীকের নির্বাচনী কার্যক্রমে সংযুক্ত হয়েছেন। শমসের মবিনকে জয়ী করতে তারা উপজেলা ও পৌর ওয়ার্ড এবং সেন্টার কমিটিও গঠন করছেন। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর শাফি চৌধুরী এলিম। বিয়ানীবাজার উপজেলার আওয়ামী লীগ সমর্থিত কয়েকজন নেতা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও শমসের মবিন চৌধুরীর পক্ষে গোপনে অবস্থান নিয়েছেন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ছাড়াও ভোটযুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী সরওয়ার হোসেন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম উদ্দিন(সাবেক এমপি)। মূলত: এই চারজনই হচ্ছে হেভিওয়েট প্রার্থী। ভোটারের মন কাড়তে প্রার্থীরা প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়াও প্রার্থী আছেন বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আতাউর রহমান (ছড়ি) এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সাদিকুর রহমান (মিনার)।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ করেই আলোচনায় আসেন বিএনপি পদত্যাগকারী শীর্ষস্থানীয় নেতা শমসের মবিন চৌধুরী। যিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০১৮ সালে বিকল্পধারার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট মহাজোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিলেন। সেই নির্বাচন অংশ নিয়ে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিলেট-৬ আসনে মহাজোটের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন দিয়ে শমসের মবিন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন। বিএনপির সাবেক এই রাজনীতিবিদ এবার তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির চেয়ারম্যান মনোনীত হন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৬ আসন থেকে (সোনালী আঁশ প্রতীক) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিএনপি-সহ তাদের সমমনা দলগুলো এবারের নির্বাচন বর্জন করায়, অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন আয়োজনে দফায় দফায় আলোচনা শেষে জাতীয় পার্টিকে ২৬ আসনে আওয়ামীলীগ ছাড় দিলেও, বাকিরা ছিলেন হিসাবের বাইরে। গেল ক’দিনের গুঞ্জনে হঠাৎ করেই বদলে গেছে আবার ভোটের হিসাব নিকাশ। ফের আলোচনায় ফিরেছেন শমসের মবিন চৌধুরী, আক্তারুজ্জামান, মেজর ইব্রাহিম এর মতো রূপ বদলানো নেতারা।
এদিকে গেল ২৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করে ১২ ঘণ্টার সফরে ঢাকায় গিয়েছিলেন সিলেট-৬ আসনের তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি পরদিন বুধবার দুপুরে সিলেটে ফিরে আসেন। পক্ষান্তরে ২৭ ডিসেম্বর বুধবার ভোটের প্রচারণা রেখে হঠাৎ করে নৌকার প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদও দুপুরে ঢাকা সফর করেন ও বিকেল ৫ টায় সিলেট প্রত্যাবর্তন করেন।
দু’প্রার্থী ঢাকা থেকে ফেরার পর নির্বাচনী মাঠের হাওয়া পাল্টে যায়। উভয় প্রার্থী এ সফরকে “ব্যক্তিগত সফর” বলে দাবি করলেও নির্বাচনী বাতাসে তাদের এ সফর নিয়ে নানামুখী জল্পনা কল্পনা ভেসে বেড়াচ্ছে। তাই ভোটারসহ রাজনৈতিক মহলে এখন কানাগোসা চলছে, এ আসনটিতে খোদ তৃণমূল বিএনপি’র চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী প্রার্থী হওয়ায় যে কোনো নাটকীয়তা ঘটে যেতে পারে! আবার কেউ কেউ বলছেন, নৌকার প্রার্থী নিয়ে এ আসনে কোনো নাটকীয় ঘটনা ঘটলে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী ঘরানার নেতা সরওয়ার হোসেনের পালে হাওয়া লাগার সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে।
এদিকে ঢাকা সফর থেকে এলাকায় ফিরেই শমসের মবিন চৌধুরী নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনে জয় ঘরে তুলতে মাঠে দুর্বার গতিতে কাজ করার নির্দেশনা দেন। তার নির্দেশনা মতো প্রচারণা বাড়াতে গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে সব জায়গায় মাইকিং, পোস্টারিং প্রচারণা বেড়ে যায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রার্থী নিজেও বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করছেন। শমসের মুবিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার পথসভা ও গণসংযোগে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যোগ দিচ্ছেন। আমি গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে দলমত-নির্বিশেষে এ আসনের ভোটাররা আমার জয় দেখতে চান। তাঁরা (ভোটার) এবার কোনো দল দেখে নয়, মানুষ দেখে ভোট দেবেন। তাই সব দলমতের ভোটাররা আমার সঙ্গে আছেন।’
শমসের মবিন চৌধুরী’র হঠাৎ চাঙ্গা মনোভাব দেখে তার কর্মী-সমর্থকেরা মনে করছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ‘সরকারকে সহায়তা’ করার বদৌলতে আওয়ামী লীগ শমসের মবিন’কে ‘অটো পাসে’ (বিনা ভোটে) সংসদ সদস্য বানাবে। কেউ কেউ আশায় আছেন, ‘গায়েবি’ ভোটে জিতবেন তিনি। কেউ কেউ আশা করছেন, নৌকার বিরুদ্ধে বিএনপির সমর্থকেরা শমসের মবিন চৌধুরীকেই ভোট দেবেন। তবে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরীসহ স্থানীয় গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের ‘পাতানো নির্বাচনে’ অংশ নিয়ে শমসের মবিন বিএনপির বিশ্বাস ভেঙেছেন। বিএনপির লোকজন সোনালী আঁশ প্রতীকের প্রার্থীকে সমর্থন করবে না।
তৃণমূল বিএনপির গণসংযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন খান বলেন, গোপনে হয়তো অনেকেই শমসের মুবিন চৌধুরীর পক্ষে আছেন। তবে যেখানে নৌকার জনপ্রিয়তা রয়েছে, সেখানে নৌকারই জয় হবে- ইনশাআল্লাহ।
এদিকে নৌকার প্রার্থী প্রবীণ রাজনীতিবিদ নুরুল ইসলাম নাহিদ একজন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। তিনি বলেন, দলীয় সভানেত্রী আমাকে নৌকার প্রার্থী দিয়েছেন। এখানে অন্য কোনো প্রশ্ন নেই। নেত্রীর নির্দেশে আমি প্রার্থী হয়েছি। আমার সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছেন।’ আর ‘আওয়ামী লীগের বিশাল পরিবার, দু-চারজন তো অভিমানী হয়ে এদিক-সেদিক যেতেই পারেন। তবে আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ পরিবার ‘নৌকা প্রতীকে’র সাথে বেঈমানী করে না। সিলেট-৬ নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ আমার (নৌকার প্রার্থী) সঙ্গেই রয়েছেন। এ আসনের উন্নয়ন বিবেচনায় ভোটার জনতা আবার আমাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন বলে আমি বিশ্বাস রাখি। এখানে বিনা ভোটে কিংবা গায়বি ভোটে এমপি হওয়ার কোন আশংকা নেই।”
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আরও বলেন, “আগামী ৭ জানুয়ারি গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজারে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ হবে। অতীতের মতো এবারও মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে। যেখানেই প্রচারণা করতে যাচ্ছি সেখানেই সাড়া পাচ্ছি ভোটারদের।’
এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার আসনের নির্বাচনী প্রচারণা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। নানামুখী বক্তৃতায় আওয়ামীলীগের অভিমানী নেতাকর্মীদের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের মিছিল মিটিংয়ে নির্বাচনী মাঠ নৌকার শ্লোগানে সরগরম হয়ে উঠছে। তাই নতুন এমপি নির্বাচনী দৌড়ে নাহিদ, নাকি শমসের মবিন- এদিকেই আলোচনা জমে উঠেছে।
অন্য দিকে কিশোরগঞ্জে নুরুল ইসলাম নাহিদের মতোই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা কুহিনূর আকন্দ আর এককভাবে মাঠে ছিলেন সাবেক বিএনপি নেতা আক্তারউজ্জামান। তবে হঠাৎ করে বদলে গেছে সেখানকার ভোটের চিত্র। আক্তারজ্জামান-কে জেতাতে মাঠে ঝাপিয়ে পড়েছেন আওয়ামীলীগের নেতারা। আর হঠাৎ করে চুপছে গেছেন নৌকার মাঝি আকন্দ। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে শাহজাহান উমর, মেজর ইব্রাহিম এর নির্বাচনী এলাকায়। তবে কি এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শমসের মবিন, আক্তারজ্জামান, ইব্রাহিমদের জন্য পৌষমাস হয়ে দেখা দিয়েছে?